২০ এপ্রিল ২০২৪ / ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / রাত ২:০১/ শনিবার
এপ্রিল ২০, ২০২৪ ২:০১ পূর্বাহ্ণ

চিকুনগুনিয়া সংকট : বর্ষার আগে ভরসা কতটা ?

     

বাংলাদেশে ২০১৭ সালে যেভাবে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ দেখা গিয়েছিল তা রীতিমত আতঙ্কিত করে তুলেছিল নগরবাসীকে। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই একে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘মহামারী’ হিসেবে। যদিও সরকারিভাবে একে মহামারী ঘোষণা করা হয়নি, কিন্তু সে সময় মশাবাহিত এ রোগটিতে কোনো না কোনো সদস্য আক্রান্ত হয়নি- ঢাকা শহরে এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া কঠিন।

রোগতত্ত্ব ও রোগনিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের দেয়া সর্বশেষ হিসেবে, গতব ছর মে মাস থেকে মাত্র সাড়ে ৪ মাসে ঢাকায় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকুনগুনিয়া সংক্রান্ত চিকিৎসা নিয়েছে ১৩ হাজার ৮০০-এ বেশি মানুষ।

এর বাইরে দুই সিটি কর্পোরেশনে চিকিৎসা সেবা নিয়েছে অনেকে। তবে এমন বহু মানুষ আছে যারা চিকিৎসা নেই জেনে হাসপাতাল বা চিকিৎসকের দ্বারস্থ হয়নি, বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এমন প্রেক্ষাপটে বর্ষা মৌসুমকে সামনে রেখে চিকুনগুনিয়ার বিস্তার ঠেকাতে কতটা প্রস্তুতি রয়েছে?

সম্প্রতি ঢাকার দক্ষিণ অংশের বিভিন্ন বাড়িতে অভিযান চালায় ঢাকা সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ। যে ১৮টি বাড়িতে তারা গিয়েছিল তার মধ্যে ১১টি বাড়িতেই এডিস মশার লার্ভা পেয়েছে। এ লার্ভা থেকেই চিকুনগুনিয়া এবং ডেঙ্গুর রোগ বহনকারী মশার জন্ম হয়।

গত বছর চিকুনগুনিয়া রোগটি নানা বয়সের মানুষের মাঝে যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে তা রীতিমতো আতঙ্কজনক এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। একই পরিবারে একাধিক মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়।

এমনই একজন ঢাকার শাহনাজ পারভিন। তিনি বলেন, ‘আমি হাঁটতে পারছিলাম না বসতে পারছিলাম নামাজও পড়তে পারছিলাম না। হাতে, আঙ্গুলে, পায়ে, পায়ের তলা, গাঁটে গাঁটে প্রচণ্ড ব্যথা। দাঁড়ালে বসতে পারি না, বসলে শুতে পারি না এমন অবস্থা।’

তিনি বলেন, এমনকি প্রস্রাব-পায়খানা করতে কমোডে বা প্যানে বসতেও কষ্ট হচ্ছিল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম ভাবলাম আমি কি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গেলাম?

উত্তরা এলাকার একজন বাসিন্দা বলছিলেন তার মাকে এক মাস আইসিইউতে রাখতে হয়েছিল। আরেকজন পুরুষ বলছিলেন ৬ মাসও পরও তার পায়ে ব্যথার কারণে ওষুধ খেতে হয়েছে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, চিকুনগুনিয়া রোগের প্রথম দিন থেকেই রোগীর অনেক বেশি তাপমাত্রায় জ্বর ওঠে। একই সাথে প্রচণ্ড মাথা ব্যথা, শরীর ব্যথা, বিশেষ করে হাড়ের জয়েন্টে ব্যথা হয়। কারো কারো শরীরে র‌্যাশ ওঠে।

জ্বর ভালো হলেও রোগটি অনেক দিন ধরে রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ফলে চিকুনগুনিয়া কর্মক্ষম অনেক মানুষকে দিনের পর দিন বাধ্য করেছিল গৃহবন্দি জীবন কাটাতে। শিশু থেকে বৃদ্ধ কেউ এর কবল থেকে বাদ পড়েননি।

চিকিৎসক এবং নগর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, গত বছরের মে, জুন ও জুলাই মাসের দিক থেকে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ তীব্র হয়ে ওঠে । খোদ নগর কর্তৃপক্ষই বলছে, গেল বছর ঢাকার কোনো এলাকা বাদ নেই যেখানে চিকুনগুনিয়া দেখা যায়নি।

তাই এ বছরও বর্ষা মৌসুম এগিয়ে আসার সাথে সাথে বিভিন্ন বাড়িতে এডিস মশার লার্ভার পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষও।

কীভাবে ছড়ায় এই চিকুনগুনিয়া? এবং কখন?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ পরিচালক অধ্যাপক সানিয়া তাহমিনা বলেন, এডিস মশা বদ্ধ পরিষ্কার পানিতে সাধারণত ডিম পাড়ে। ফ্লটিং ওয়াটারে অর্থাৎ পুকুরে বা নদীর পানিতে হবেনা।আশেপাশে পরিত্যক্ত টায়ার, কন্টেনাইর, পাস্টিক, টবের পানি, এসির বা ফ্রিজের জমে তাকা পানি, বাসা-বাড়িতে ফ্লাওয়ার ভাসে যদি পানি থাকে সেখানে এই মশা ডিম পাড়তে পারে।

রোগ নিয়ন্ত্রণ ও রোগ তত্ত্ব আইইডিসিআরের ওয়েবসাইটের সর্বশেষ হিসাব অনুসারে, ঢাকা শহরে অবস্থিত বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসা নেয়া চিকুনগুনিয়া ও চিকুনগুনিয়া পরবর্তী আর্থ্রালজিয়া রোগীর সংখ্যা ১২ মে ২০১৭ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত ১৩ হাজার ৮১৪ জন। ওই সময় পর্যন্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের বাইরের বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জন ও মেডিকেল কলেজ থেকে ১৭টি জেলা থেকে ১৮৫ জনের তথ্য পাঠানো হয়।

তবে বাস্তবতা হলো চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত বহু মানুষ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হননি।

ফলে ঠিক কত সংখ্যক মানুষ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই, যেমনটা বলছিলেন অধ্যাপক সানিয়া তাহমিনা।

রোগ নিয়ন্ত্রণ ও রোগ তত্ত্ব কর্তৃপক্ষ বলছে, হঠাৎ ভারী বর্ষণ এবং আসন্ন বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার বংশ বিস্তারের কারণে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের প্রকোপ বাড়তে পারে।

অধ্যাপক সানিয়া তাহমিনা বলছিলেন, কোন কোন এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ তা জানতে এ বছর জানুয়ারি এবং চলতি মে মাসে তারা দুটি জরিপ করা হয়েছে। এ অবস্থায় এই রোগের বিষয়ে আগাম সতর্কতা ও এডিস মশা নির্মূলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি বলে পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।

গতবছরের অভিজ্ঞতায় এ বছর সতর্কতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে দুই সিটি কর্পোরেশনও।

ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, গতবারের মতো পরিস্থিতি যাতে না ঘটে সে জন্য তারা এবার বাড়তি সতর্কতায় কি ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন তারা।

সাইদ খোকন বলেন, গত বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা এ বছর একটু আগামভাবেই সতর্ক ইতোমধ্যে মশার প্রজনন-ক্ষেত্র চিহ্নিত করে লার্ভা পাওয়া গেছে। সেকারণে আমরা কিছুটা হলেও চিন্তিত।রাজধানীর গুলশান বনানীর মতো সেসব এলাকাতে রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ যে পরীক্ষা চালিয়েছে কিছু দিন আগে সেখানে সবচেয়ে মশক প্রবণ বা চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে উঠে এসেছে এসব এলাকার নামও। ফলে উদ্বেগ রয়েছে বিভিন্ন এলাকার মানুষের মাঝে ।

‘মশা মারার লোক কয়দিন আসে তারপর আর দেখি না। এবারও বর্ষা আসছে। আবারও চিকুনগুনিয়া হয় কিনা ভয় লাগতেছে’। আরেকজন বলেন, ‘একজন লোক দেখি আসে। মাঝে মাঝে ধোঁয়া দিয়ে যায় যেইটা দিয়ে মশা মারে।’

উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা এমনটাই বলছিলেন।

কিন্তু মশার বিস্তার ঠেকাতে আসলে কি করছে ঢাকা উত্তরের কর্তাব্যক্তিরা?
ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জাকির হাসান বলছিলেন, প্রাক-বর্ষা মৌসুমে যেহেতু চিকুনগুনিয়ার বিস্তার দেখা যায় তাই মে মাসের শুরু থেকেই মশা নিধন কাজ শুরু করেছেন অতিরিক্ত জনবল নিয়োগের মাধ্যমে।

‘আইইডিসিআর বছরের প্রথমদিকে একটি সার্ভে করে কিছু কিছু এলাকা শনাক্ত করেছিল। যেমন বলা হয়েছিল বনানীতে এডিসের প্রকোপটা বেশি। কিন্তু তার মানে কি এই যে আমার গুলশানে হবে না, মিরপুরে হবেনা? সবগুলো এলাকাকেই কিন্তু গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা হচ্ছে। আমরা ৩৬টা ওয়ার্ডের সবগুলোতেই কিন্তু কাজ শুরু করেছি। অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ করে কার্যক্রম চলছে।’

গত বছরের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ৬ মে থেকে তারা সচেতনতা বাড়ানোর কাজ শুরু করেছেন বলে জানান প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বিভিন্ন বাড়ির মালিকদেরও চিঠি দেয়া হয়েছে পরিচ্ছন্নতার জন্য।

চিকিৎসকরা বলছেন, চিকুনগুনিয়ার প্রতিষেধক নেই, তাই সচেতনতাই এই ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের প্রধান উপায়। মশা থেকে সতর্কতা, যেমন মশারি বা ওষুধ ব্যবহার করা এ থেকে রক্ষার সবচেয়ে ভালো উপায়। বৃষ্টির পর যাতে পানি জমে থাকতে না পারে, যেখানে মশা ডিম পাড়তে পারে, সেদিকেও নজর দিতে তারা পরামর্শ দিচ্ছেন।

তবে ঢাকাকে ঘিরে নানারকম প্রস্তুতি এবং সতর্কতামূলক কর্মকাণ্ড নজরে এলেও ঢাকার বাইরে সর্তকতা ও প্রস্তুতির বিষয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা। ঢাকার বাইরে গতবছর চিকুনগুনিয়া প্রকটভাবে দেখা নো গেলেও এবার তা বড় আকারে দেখা যেতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে- জানান প্রফেসর সানিয়া তাহমিনা।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply