আদালতের রায় মানছেন না সীতাকুণ্ডের ইউএনও!
শহীদুল্লাহ শাহরিয়ার
আদালতের রায়ের পরও চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের ছলিমপুরের খন্দকার মসজিদ ও কালুশাহ মাজার ওয়াকফ এস্টেটের মোতাওয়াল্লির অধিকার ফিরে পাচ্ছেন না খন্দকার মোহাম্মদ আলী। অথচ এ অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য বত্রিশ বছর আদালতে ধরনা দিয়েছেন তিনি। অনেক রাত কাটিয়েছেন আদালতের বারান্দায়। শেষ পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে জিতেও ন্যায্য অধিকার ফিরে পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রায়ের পর ওয়াকফের মোতাওয়াল্লির অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ওয়াকফ প্রশাসক এবং জেলা প্রশাসন থেকে চিঠিও দেয়া হয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে। কিন্তু রায় বাস্তবায়ন, ওয়াকফ প্রশাসন কিংবা জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা বা আদেশ বাস্তবায়ন ‘প্রয়োজন’ মনে করছেন না উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। সবকিছুই তার কাছে ‘বোগাস’। ওয়াকফ এস্টেটের মোতাওয়াল্লি এ বিষয়ে জানতে গেলে তাকে দ্বিতীয়বার তার অফিসে যেতে নিষেধ করেন। গেলে বেঁধে রাখা হবে বলেও হুমকি দেন।
ইউএনও নাজমুল ইসলাম ভুঁইয়ার এমন হুমকিতে তটস্থ মোতাওয়াল্লি খন্দকার মোহাম্মদ আলী যুগান্তরকে বলেন, “সুপ্রিমকোর্টের রায় কিংবা ঊর্ধ্বতন প্রশাসনের নির্দেশও একজন অধঃস্তন কর্মকর্তা মানছেন না। বিষয়টিকে ‘বোগাস’ বলছেন। ইউএনও আমাকেই ধমক দিচ্ছেন। তাহলে আমি কোথায় যাব। কার কাছে আর বিচার চাইব। কেনই বা এতদিন মামলার ঘানি টানলাম। তাহলে আইন-আদালত কিসের জন্য?” তিনি বলেন, ‘আদালতের পেছনে দৌড়ে সহায়-সম্পদ সব হারিয়েছি। এখন ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াও বন্ধ অর্থাভাবে।’
জানা যায়, সীতাকুন্ডের ছলিমপুরে ৬৬২ শতক জায়গায় ওয়াকফ সম্পত্তির মালিক ছিলেন লতিফা খাতুন। তার দুই ছেলে মনির আহম্মদ ও আলী আহম্মদ ছিলেন ওয়াকফের মোতাওয়াল্লি। তাদের ওয়ারিশ হিসেবে পরে মোতাওয়াল্লি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মসিহ উদ্দৌল্লা খন্দকার, সিরাজ উদ্দৌলা খন্দকার ও লুৎফুল কবির খন্দকার। সিরজা উদ্দৌলা খন্দকার ও লুৎফুল কবির খন্দকারের কোনো ওয়ারিশ না থাকায় ওই ওয়াকফের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন মসিহ উদ্দৌলা খন্দকারের দুই ছেলে খন্দকার শওকত আলী ও খন্দকার মোহাম্মদ আলী। এরপর সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু ১৯৮৫ সালে এসে আবদুল কুদ্দুছ নামে এক ব্যক্তি খন্দকার মসজিদ ও কালুশাহ মাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক দাবি করে মামলা ঠুকে দেন আদালতে। সেই যে মামলা শুরু তা চলে দীর্ঘ প্রায় ৩২ বছর (সর্বশেষ ওয়াকফের আদেশের চিঠি পাওয়া পর্যন্ত)। মামলা চলাকালে ১৯৮৯ সালে সীতাকুন্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে রিসিভার নিয়োগ করা হয়। এরই মধ্যে প্রায় প্রতিটি মামলার রায় পান খন্দকার শওকত আলী ও খন্দকার মোহাম্মদ আলী। বাদী আবদুল কুদ্দুসের মৃত্যুর পর দৃশ্যপটে চলে আসেন সিরাজ উল্লাহ সওদাগর ওরফে দৌল্লা সওদাগর। কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনিই এই ওয়াকফ এস্টেট পরিচালনা করতে থাকেন।
সূত্রমতে, সর্বশেষ ২০০৯ সালের ১৬ মার্চ লিভ টু আপিলের (নম্বর : ৯৩৫/২০০৮) রায়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত কথিত এ কমিটিকে অবৈধ ঘোষণা করেন। আবেদনকারী খন্দকার শওকত আলী ও খন্দকার মোহাম্মদ আলীকে এস্টেটের রাইট অ্যান্ড টাইটেল দেয়ার নির্দেশ দেন।
সূত্র জানায়, সব আদেশের সার্টিফাইড কপি ওয়াকফ প্রশাসনে জমা দিয়ে আদালতের রায় অনুযায়ী মোতাওয়াল্লি হিসেবে ওয়াকফ এস্টেট পরিচালনার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে ওয়াকফ প্রশাসক বরাবরে আবেদন করেন খন্দকার শওকত আলী ও খন্দকার মোহাম্মদ আলী। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের
১৬ অক্টোবর সহকারী ওয়াকফ প্রশাসক স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সীতাকুন্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে চিঠি দেন। ওই চিঠি নিয়ে সীতাকুন্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম ভুঁইয়ার কাছে গেলে তিনি ‘ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন মনে করেন না’ উল্লেখ করে মোতাওয়াল্লি দাবিদার খন্দকার মোহাম্মদ আলীকে ফিরিয়ে দেন। এ বিষয়ে খন্দকার মোহাম্মদ আলী চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে একটি চিঠি দেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও সীতাকুন্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে আবেদনের বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বলেন। কিন্তু সেই চিঠিও আমলে না নিয়ে উল্টো খন্দকার মোহাম্মদ আলীকে ইউএনও ধমক দেন।
অবৈধভাবে এস্টেট পরিচালনা ও অর্থ লুটপাট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কালু শাহ মসজিদ ও মাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক সিরাজ উদ্দৌল্লা ওরফে দৌল্লা সওদাগর যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রশাসন আমাকে এস্টেট ছেড়ে দিতে বললে আমি এখনই ছেড়ে দেব। এককভাবে এখানে কিছু করার সুযোগ নেই। কমিটিই এস্টেট পরিচালনা করছে। ’
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক জিল্লর রহমান চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, সুপ্রিমকোর্টের রায় বা নির্দেশনা থাকলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া অবশ্যই প্রশাসনের কর্তব্য। কালু শাহ মাজার ওয়াকফ এস্টেটের মোতাওয়াল্লি হিসেবে খন্দকার মোহাম্মদ আলী নামে এক ব্যক্তি আমার কাছে আবেদন করেন। আমি ইউএনওকে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বলেছি। ইউএনও কেন ব্যবস্থা নেননি জানি না। ইউএনও যদি না নেন প্রয়োজনে আমি ব্যবস্থা নেব। আমি শুনানি নেব। আইনের বাইরে যাওয়া কারও সুযোগ নেই। সুত্র যুগান্তর