মাহমুদুল হক আনসারী
বাংলা নববর্ষ আমাদের ঐতিহ্য। আমাদের স্বাধীনতা, স্বকিয়তা ও সংস্কৃতির নাম পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখ অর্থ হলো বাংলা সনের নতুন মাস। বাংলার গননার নতুন সংস্কৃতি অধ্যায় শুরু হয় বৈশাখ দিয়ে। এই বৈশাখ মাসের সাথে গননার শুরু হয় হালখাতায়। বিগত বছরের সব হিসেব নিকেশ সমাপ্ত করে বৈশাখের প্রথম দিন হালখাতা লিখা শুরু হয়। বাংলার ঘরে ঘরে বৈশাখ মাস আনন্দ, উদ্দিপনা নতুন কিছু খাবার আশা নিয়ে ঘরে ঘরে ফিরে আসে। বৈশাখ মানে বাঙ্গালি জাতির সংস্কৃতি হাসি কান্না উল্লাসের মাস।
বৈশাখ মাস জুড়েই বাংলার প্রতিটি পাড়া মহল্লা ঘরে ঘরে নবান্নে উৎসব চলে। পিঠা, পায়েস, সংস্কৃতি, আউল বাউল গানের আসর বসে। গ্রাম্য ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি লালনে, পালনে নানা প্রকারের অনুষ্ঠানাদি অত্যন্ত আনন্দ মুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ বৈশাখ মাসটি বরন করতে উদগ্রিব থাকে। বৈশাখ হলো বাঙ্গালি জাতির অনুপ্রেরণা। ভালো মন্দ, হাসি কান্না, উৎসব, অনুষ্ঠানের একটি অধ্যায়। বৈশাখকে বরণ করা লালন পালনে সংস্কৃতির মিলনে মেলবদ্ধ হওয়া জাতীয় একটি ঐক্যবদ্ধ চরিত্র।
পহেলা বৈশাখ হচ্ছে লোকজের সঙ্গে নাগরিক জীবনের একটি সেতুবন্ধ। ব্যস্ত নগর কিংবা গ্রামীণ জীবন যেটাই বলা হোক না কেন, এই নববর্ষই বাঙালি জাতিকে একত্র করে জাতীয়তাবোধে। এ অনুষ্ঠান পরিণত হয় প্রত্যেকটি বাঙালির কাছে শিকড়ের মিলনমেলায়। ধর্ম, বর্ণ সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে বাঙালি জাতি এই নববর্ষকে সাদরে আমন্ত্রণ জানায়। আসছে বাঙালির প্রাণের উৎসবের দিন পহেলা বৈশাখ। বছরের প্রথম দিনটি বাঙালিরই শুধু নয়, বাংলা ভাষাভাষী আদিবাসী ও নৃতাত্তি¡ক জনগোষ্ঠী, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকটি মানুষের জীবন-জগতে স্বপ্নময় নতুন বছরের শুভ সূচনা ঘটায়। জীর্ণ-পুরোনোকে পেছনে ফেলে সম্ভাবনার নতুন বছরে প্রবেশ করে বাঙালি জাতি।
পহেলা বৈশাখ, বাংলা সনের প্রথম দিন। এ দিনটি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, ত্রিপুরাসহ দেশ-বিদেশে বসবাসরত প্রত্যেকটি বাঙালি নববর্ষ হিসেবে পালন করে। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন প্রাণের উৎসব। বাঙালি এই প্রাণের উৎসবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছে আবহমান বাংলার কৃষি। গ্রামীণ মেলাগুলো পরিণত হয় উৎসবে। এই উৎসবের রং একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়তে বাঙালি জাতিকে এগিয়ে নিয়েছে বারবার। দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে সরকার বাংলাদেশের চাকরিজীবীদের জন্য ঈদ-পূজার বোনাসের মতো ‘বৈশাখী ভাতা’ চালু করেছে। এটিও বড় আনন্দের কথা।
কৃষি কৃষকের জন্য পহেলা বৈশাখ একটি নতুন দিন। কৃষি পণ্য উৎপাদন বাজারজাত লোকজ সংস্কৃতি ব্যপকভাবে আদান প্রদান বৈশাখের বৈশিষ্ঠ্য।
কৃষিকাজ হলো বিশেষ ঋতুনির্ভর। ফসল বোনা, ফসলের সময়ভিত্তিক যতœ বা পরিচর্যা, ফসল কাটাসহ যাবতীয় কৃষিকাজ বাংলা সন-তারিখ পঞ্জিকা অনুযায়ী নিষ্পন্ন করা হতো। বাংলায় হরেক রকম মেলার দিন-তারিখও নির্ধারিত ছিল বাংলা সনের সঙ্গে। শুধু ফসল আর উৎসব নয়, বাঙালির কৃষকের পারিবারিক ও সামাজিক কাজকর্ম, বিবাহ, জন্ম-মৃত্যুসহ জীবনের সব বিষয়েই বাংলা সন ছিল একক ও অনন্য। ভারতবর্ষে খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা তথা ফসলি সন ১৫৫৬ সালের ১৪ এপ্রিল প্রবর্তন করেন। তবে শুরুর দিন কিন্তু ১ সাল ছিল না, ছিল ৯৬৩ সাল। তখন এ দেশে হিজরি সাল প্রচলিত ছিল। হিজরি বছরটিকে ঠিক রেখেই নতুন একটি বর্ষপঞ্জি চালু করা হয়। বাংলা দিনপঞ্জির সঙ্গে হিজরি ও খ্রিস্টীয় সালের মৌলিক পার্থক্য হলো হিজরি সাল চাঁদের হিসাবে এবং খ্রিস্টীয় সাল ঘড়ির হিসাবে চলে।
এ কারণে হিজরি সালে নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় নতুন চাঁদের আগমনে। ইংরেজি দিন শুরু হয় মধ্যরাতে। আর বাংলা সনের দিন শুরু হয় ভোরে, সূর্যদয়ের সঙ্গে সঙ্গে। কাজেই সূরে‌্যাদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় বর্তমান পরিচিত পান্তা খাওয়া বাঙালির পহেলা বৈশাখের উৎসব। বাংলা সন ও বাঙালির ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির অবস্থান বর্তমান বাংলাদেশে আর আগের মতো নেই। এখন মানুষ লেখাপড়া শিখছে। গ্রামীণ অর্থনীতির মধ্যে নানা উপাদান যুক্ত হয়ে নতুন গতিবেগ সঞ্চার হয়েছে এবং এতে অনেকের অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে, হাতে নগদ পয়সা আসার উৎস সৃষ্টি হয়েছে। ফলে জীবনধারার সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন ঘটেছে সামাজিক রীতিনীতি ও অভ্যাসের। এই পরিবর্তনের ফলে বাঙালির ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির উপাদান এবং জীবনযাত্রার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত বাংলা সনও আর এখন একাধিপত্য করতে পারছে না। বরং গ্রামজীবনের নতুন ধারা বা শহরের বাস বা বিদেশে চাকরিবাকরির সুবাদে ইংরেজি সালের ব্যবহার বেড়েছে। কিন্তু আমাদের জাতিসত্তায় আছে বঙ্গাব্দ।
বাংলা সন কিংবা বঙ্গাব্দ বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে। বাংলা সনকে উদযাপন করা মানে নিজের অস্তিত্বকেই স্বীকার করা। নগর সংস্কৃতিতে পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ কেবল এক দিনের উৎসব-আনন্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ হলেও গ্রামীণ সংস্কৃতি এবং জাতীয় সংস্কৃতিতে এর প্রভাব এখনো অনস্বীকার্য। বিশ্বের সব জাতিই নিজ সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে বর্ষবরণ পালন করে।
আমাদের দেশে অনেকে পহেলা বৈশাখে নববর্ষে বাউল বা বৈরাগীর বেশ ধারণ করে উৎসব পালন করে। বাংলা নববর্ষের ভেতর দিয়ে মূলত দেশের আপামর জনসাধারণ নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে লালন করে চলেছে। পহেলা বৈশাখের উৎসবের মধ্য দিয়ে এ দেশের নর-নারী এ ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। নতুবা আমাদের নতুন প্রজন্ম বাংলার ঐতিহ্য লোকসংস্কৃতির কিংবা বাংলা ঋতুর কথা ভুলেই যেত।
আজকের সময়ে বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তিকালীন সরকার দেশ পরিচালনা করছেন। আট মাসের অন্তর্বর্তিকালীন এই সরকার জনগনের হৃদয়ে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে। জনগনের প্রয়োজনীয় নিত্য পণ্যের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। জনগনের মধ্যে বিভিন্ন ভাবে সামাজিক চাহিদা পূরণে স্বস্তি দেখা যাচ্ছে। এই সরকারের প্রধাণ উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনুসের প্রতি প্রান্তি জনগোষ্টির অকুন্ঠ সমর্থন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবী ব্যাপি প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশকে উন্নত দেশের সারিতে নিয়ে যেতে বলিষ্ঠ ভূমিকা লক্ষ করছি। ফলে দেশ ও জনগন পহেলা বৈশাখের নববর্ষের আনন্দের সাথে সরকারের অব্যাহত সফলতায় খুশির মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।
দেশ ও জাতির মঙ্গলে জনগণের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত দেশপ্রেম জাগ্রত হোক, দেশ ও জনগনের মধ্যে ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ তৈরি হোক। সরকারের প্রচেষ্ঠায় খুলে যাক সম্ভাবনার আরো নতুন দুয়ার। বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। অর্থনীতির সফলতায় দেশ এগিয়ে যাক বাংলা নববর্ষে প্রত্যাশা জনগনের।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ