২০ এপ্রিল ২০২৪ / ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / দুপুর ১২:১৩/ শনিবার
এপ্রিল ২০, ২০২৪ ১২:১৩ অপরাহ্ণ

প্রাচীন পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম প্রসঙ্গ

     

সোহেল মুহাম্মদ ফখরুদ-দীন

পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় একটি প্রাচীন সময়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যদিও বলা হয় এটি বৌদ্ধ ধর্মীয় ধর্ম চর্চা কেন্দ্র বা বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরুদের শিক্ষা প্রদানের জন্য একটি প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় এটি কোথায় অবস্থিত এই বিষয়ে লেখক গবেষকদের মতবিরোধ আছে। তবে অনেক লেখকের মতে এটি বাংলাদেশের চট্টগ্রামে অবস্থান বলে উল্লেখিত হয়েছে। কেউ বলেছেন, দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়ার চক্রশালা, আবার কেউ বলেছেন দেয়াং পাহাড়ের বিশ্ব মুড়ায়, আবার অনেকেই বলেছেন, আনোয়ারা উপজেলার ঝিয়রী গ্রাম কিংবা সীতাকুণ্ডের ঐতিহ্যবাহী চন্দ্রনাথ পাহাড়শীর্ষে ও মীরেশ্বরাই থানার পরাগলপুরের ছুটি খাঁর দিঘীর সন্নিকটবর্তী এলাকায় পণ্ডিত বিহার অবস্থিত ছিল বলে মত প্রকাশ করেছেন। বিগত ৫/৬ বছর ধরে পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান নির্ণয় করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ড. জিনবোধি ভিক্ষু এই বিশ্ববিদ্যালয় নবরূপে প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে চলেছেন। ইতিমধ্যে আনোয়ারার ঝিয়রী গ্রামে তিনি বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের শিক্ষা প্রতিনিধিদের নিয়ে ঐস্থান পরিদর্শন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠায় অর্থ যোগানের জন্য ইতিমধ্যে তিনি আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ দাতা সংস্থার কাছে আবেদন নিবেদন করেছেন। পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মহামান্য রাষ্ট্রপতির সু-দৃষ্টি কামনা করে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সর্বপ্রকার সহযোগিতা কামনা করেছেন। ইতিমধ্যে প্রফেসর ড. জিনবোধি ভিক্ষু প্রায় সভা সমাবেশে ঐবিশ্ববিদ্যালয় নব প্রতিষ্ঠার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন। পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় যদি চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় কিংবা পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচীন সময়ে চট্টগ্রামে ছিল এটির অবস্থান নির্ণয় সম্পন্ন হয় তাহলে এই চট্টগ্রাম প্রাচীন সময়ের শিক্ষিত জনগোষ্টী হিসেবে প্রমাণিত হবে। কেননা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রাচীন সময়ে এই চট্টগ্রামে ছিল এবং ঐপ্রতিষ্ঠান সমগ্র বিশ্বব্যাপী পরিচিত ছিল। এটি চট্টগ্রামবাসীর জন্য আজকের সময়ে গৌরব ও সম্মানের বিষয়। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ পণ্ডিত গবেষক আবদুল হক চৌধুরী তাঁর রচিত চট্টগ্রাম-আরাকান গ্রন্থের ৩২-৩৩ পৃষ্টায় লিখেছেন, “বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে নালন্দা, সোমপুর বা পাহাড়পুর ও পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শীর্ষস্থানীয়। সপ্তম শতকে দক্ষিণ বিহারে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় এবং নবম শতকের শেষে ধ্বংস হয়ে যায়। তিব্বতের লামা তারানাথ লিখিত বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস সূত্রে জানা যায় যে, খ্রীষ্টীয় দশম শতকে চট্টগ্রামে পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। সম্ভবত পূর্ববঙ্গের চন্দ্রবংশীয় রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় স্থাপিত তৎকালীন চট্টগ্রামের পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় ছিল পূর্ববঙ্গের তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম বিষয়ক শিক্ষা ও মতবাদ প্রচারের প্রধান কেন্দ্র। পণ্ডিতবিহারের অধ্যক্ষ ছিলেন, পটিয়া থানার চক্রশালার নিবাসী এক ব্রাহ্মণ সন্তান তিলপাদ। তিলপাদ নামের উৎপত্তি সম্পর্কে কথিত হয় যে, তাঁর হিন্দু জীবনের যোগসাধন সঙ্গিনী তিল পিষে জীবন ধারণ করতেন বলে তিনি তিল পাদ নাম গ্রহণ করেছিলেন। বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করার পর তিনি প্রজ্ঞাভদ্র নাম গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তী কালে তিনি পণ্ডিতবিহারের অধ্যক্ষ পদে নির্বাচিত হন। মগধের প্রধান আচার্য নারোপা বা নারোতপা পণ্ডিত বিহারে আগমন করে প্রজ্ঞাভদ্রের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। সবরিপা লুইপা, লাড়পা, থবধুতপা, অমোঘনাথ, ধর্মশ্রী, মৈন, বুদ্ধপা, জ্ঞানপা, অনঙ্গবজ্র প্রমূখ তৎকালীন খ্যাতনামা বৌদ্ধসিদ্ধ ও আচার্যগণ পণ্ডিতবিহারে পরিদর্শক রূপে অথবা অধ্যাপক রূপে আগমন করেছিলেন বলে জানা যায়। উল্লেখিত সর্বভারতীয় খ্যাতনামা বৌদ্ধ পণ্ডিতগণ এখানে সম্মিলিত হয়ে বৌদ্ধমত ও দর্শন চর্চা করতেন বলেই চট্টগ্রামের এই বৌদ্ধ বিহারটি পণ্ডিত বিহার নামে খ্যাত হয়েছিল। তিব্বতী জ্ঞানকোষ ‘তেঙ্গুর’ গ্রন্থে পণ্ডিত বিহারের অধ্যক্ষ তিলপাদ ও প্রজ্ঞাভদ্র দুটি নামই পাওয়া যায়। প্রজ্ঞাভদ্র প্রাচীন সংস্কৃত ও পালি মিশ্রিত ভাষায় ছয়খানি গ্রন্থ রচনা করেন। যথা: ১। শ্রী সহজ সম্বর স্বাধিষ্টন, ২। অচিন্ত মহামুদ্রা নাম, ৩। তত্ত্ব চতুরোপদেশ প্রসন্নদীপ, ৪। দোহাকোষ, ৫। ষড়ধর্মোপদেশ নাম, ৬। মহা সমুদ্রোপদেশ। পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতদের প্রধান কাজ ছিল তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারীদের পূজার জন্য অসংখ্য দেবদেবীর কল্পনা, তাঁদের মণ্ডল অংকন, স্তব, স্তোত্র ধারণী, মন্ত্র ও তাদের টীকাটীপ্পনী সমেত গ্রন্থ রচনা করা। তবে এ সম্পর্কে মতভেদও আছে। যেমন: তেঙ্গুর গ্রন্থে পণ্ডিত বিহারের নাম পাওয়া যায়না প্রজ্ঞাভদ্রের অচিন্ত মহামুদ্রানাম গ্রন্থটি যশ; পালপুর নামক স্থানে রচনা করেন। তাঁর রচিত তত্ত্বচতুরোপদেশ প্রসন্নদীপ নামক গ্রন্থের তথ্য অনুসারে তাঁকে উড্ডীয়ানের লোক বলা যায় এই উড্ডীয়ান নামক স্থানটি বিতর্কিত, কেউ বলেন আধুনিক পাকিস্তানের উত্তরপশ্চিমসীমান্ত প্রদেশে, কেউ বলেন উড়িষ্যায়, আর কেউ বলেন আসামে, অনেকে বলেন চট্টগ্রামে। প্রজ্ঞাভদ্র শিষ্য নারোপাকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তা মহাসমুদ্রোপদেশ নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। সে গ্রন্থ সূত্রে জানা যায় যে, তিনি গঙ্গা তীরেই গ্রন্থোক্ত উপদেশাবলী দান করেন। পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান নিয়ে পন্ডিতগণের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। তিব্বত বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত শরচ চন্দ্র দাশ অনুমান করেন যে, চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লাস্থ জামে মসজিদ পাহাড়শীর্ষে পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত ছিল। পটিয়ার চক্রশালা, দেয়াঙ্গ পাহাড়ের বিশ্ব মুড়ায়, আনোয়ারা থানার ঝিয়রী, সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়শীর্ষে, মীরেশ্বরাই থানার পরাগলপুরের ছুটি খাঁর দিঘীর সন্নিকটবর্তী এলাকায় পণ্ডিত বিহার অবস্থিত ছিল বলে বিভিন্ন মতামত প্রকাশ করেন”। ইতিহাস গবেষণায় ও ডিবি খননের মাধ্যমে যদি চট্টগ্রামে পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় এর অবস্থান চট্টগ্রামে আবিষ্কার করা সম্ভব হয় তাহলে এই চট্টগ্রাম বা চট্টগ্রামবাসী গর্বিত ইতিহাসের অংশীদার হিসেবে বিবেচিত হবে। দেশের প্রতœসম্পদ অধিদপ্তর এই বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহন করুক এটি জনগনের প্রত্যাশা।
সহায়ক তথ্য: নলিনী কান্তদাশ, পণ্ডিত বিহারে তিলাপাদ প্রবন্ধ; আবদুল হক চৌধুরী, চট্টগ্রামে আরকান; মোহাম্মদ আবুল কালাম জাকারিয়া, বাংলাদেশের প্রতœ সম্পদ; সোহেল মো. ফখরুদ-দীন, ইতিহাস প্রসঙ্গ; ড. আহমদ শরীফ, চট্টগ্রামের আদিযুগ; পূর্ণচন্দ্র চৌধুরী, চট্টগ্রামের ইতিহাস।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply