১৮ এপ্রিল ২০২৪ / ৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / রাত ৯:৫০/ বৃহস্পতিবার
এপ্রিল ১৮, ২০২৪ ৯:৫০ অপরাহ্ণ

ষোড়শ সংশোধনী: আদালতের রায়ে সংসদে ক্ষোভ

     

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া সুপ্রিমকোর্টের রায়ের বিষয়ে সংসদে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন এমপিরা। বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাত থেকে ফিরিয়ে নেয়ার যে রায় দেয়া হয়েছে তার তীব্র সমালোচনা করেন তারা।  রবিবার রাতে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে জাসদের সদস্য মইনউদ্দিন খান বাদল বিষয়টি উত্থাপন করলে এর উপর ১০ জন সংসদ সদস্য অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নেন।

আলোচনা শেষে স্পিকার বলেন, ‘জাতীয় সংসদে পরবর্তীতে আলোচনার বিষয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে নির্ধারিত দিনে আলোচনা হতে পারে।’

আলোচনায় অংশ নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছেন। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিচারপতিদের বিচার করবে। আমার প্রশ্ন- প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলে তার অধীনস্তরা কী তার বিচার করতে পারবেন?’

তিনি বলেন, সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে তারা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলেছেন। সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ। সংসদ সদস্যরা সেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত। আইপিইউ-সিপিএ এ’র চেয়ারম্যান এই সংসদেরই সদস্য।

তোফায়েল বলেন, সংবিধানকে কেউ যদি ধ্বংস করে থাকেন তিনি হলেন জিয়াউর রহমান। তিনি আইয়ুব খানকে অনুসরণ করে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল করেছিলেন। এখন সেটা রক্ষা করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী পদক্ষেপ নেবেন।

বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কিছু বলার নেই। কিন্তু যারা সমর্থন করেছেন তাদের নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। তারা সুবিধাবাদি। আপনি সংবিধান প্রণয়নের সময় বললেন, ‘বেস্ট সংবিধান বাট, এখন কার বিরোধিতা করছেন। কারণ আপনারা সংসদ সদস্য হতে পারেননি।’

এ্যামিকাস কিউরি ড. কামাল হোসেন ভারতের সংবিধানের কথা বলে আদালতকে অসত্য তথ্য দিয়েছেন। সেখানে বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা এখনও লোকসভা ও বিধানসভার হাতেই রয়েছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রে, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলংকা, নেপালেও একই ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে পাকিস্তান। সেখানে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারক অপসারণ করতে হয়। এই কাউন্সিল করেছিলেন আইয়ুব খান, যার বিরুদ্ধে আমরা ’৬৯-এর গণঅভূত্থান করেছিলাম।

কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, জিয়াউর রহমান এক ফরমান বলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল করেছিলেন। এটা এখনো পাকিস্তানে বহাল রয়েছে।

তিনি এ্যামিকাস কিউরিদের সমালোচনা করে বলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় জেনারেল টিক্কা খানের কাছে ফোন করে প্রাণ ভিক্ষা চাইতে পারে তাদের দ্বারা দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্র নিরাপদ থাকতে পারে না।

সরকারি দলের সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করবে জনগণের প্রতিনিধিরা। আমরা যারা সংসদ সদস্য আছি তারা জনগণের পক্ষেই এ সমস্ত কার্যক্রম করবো।’

তিনি বলেন, ‘বিচার বিভাগ স্বাধীন। কিন্তু কতটুকু স্বাধীন। সংসদের চেয়েও স্বাধীন? তা হতে পারে না।’

তিনি বলেন, ‘সংসদের হাতে ক্ষমতা থাকবে। আপনি রায় দিয়েছেন, রায় নিয়ে বসে থাকেন। এই সংসদ যদি ওটাকে কার্যকর না করে তাহলে ওটা কোনদিনই কার্যকর হবে না।’

শেখ সেলিম বলেন, ৮ জন বিচারপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের বিচার করতে বিব্রতবোধ করেছেন। এদের সবার বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট করা দরকার ছিল।

ওই বেঞ্চের এমিকাস কিউরি ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘এরা কত বড় সুবিধাভোগী লোক। এখন সংবিধান ও সংসদের সাথে একটা কনফ্লিক্ট লাগিয়ে যদি কোন রেজাল্ট পাওয়া যায়। এই হল তাদের পরিকল্পনা।’

তিনি বলেন, এরা সংবিধান, বিচার বিভাগ ও সংসদের মধ্যে একটা টানাপোড়েন সৃষ্টি করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে। এরা জঘন্য খেলায় মেতেছে।

সংবিধানকে রক্ষা করার স্বার্থে ৩৫০ জন সংসদ সদস্যকে ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করতে হবে।

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় যেমন আমরা বিশ্বাস করি তেমনি বিচার বিভাগের দায়বদ্ধতাও থাকা উচিত।

তিনি বলেন, ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর এই সংসদে ষোড়শ সংশোধনী সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ২ বছর ১০ মাস ১১দিন পর সুপ্রিমকোর্ট ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়। এই ষোড়শ সংশোধনীকে কেন্দ্র করে সারা দেশে যখন আলোচনার সূত্রপাত হয় তখন বিচার বিভাগের দায় দায়িত্ব, ক্ষমতা, স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা, অসদাচরণ, অসততার বিষয়গুলো আলোচনার মধ্যে এসেছে।

তিনি বলেন, সংসদ জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রতিনিধিত্ব করে। এই সংসদ যদি সংবিধানের বাইরে যায় তা দেখার দায়িত্বও বিচার বিভাগের উপর ন্যস্ত রয়েছে। এই অসীম ক্ষমতা বিচার বিভাগের উপর ন্যস্ত থাকার পরও বিচার বিভাগের সদস্যরা ভুল করতে পারে। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত ’৭২-এর মূল সংবিধানের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা রয়েছে।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমাদের পূর্বসূরীরা এই সংবিধান প্রণয়ন করেছেন। এটাকে বদলানো বা এই সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোন অধিকার কারো নেই।

এ্যামিকাস কিউরি ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামের সমালোচনা করে তিনি বলেন, এরা বিভিন্ন সময়ে রং বদলিয়েছেন। এরা আবারও ষড়যন্ত্রে মেতেছেন। এটা নতুন কোন চক্রান্ত কি না তা দেখতে হবে।

মইনউদ্দিন খান বাদল বলেন, ‘বিচারক যদি এমন কাজ করে, তাতে তার বিচারক থাকা চলে না, অবিবেচনা প্রসূত কাজ করে, অপরাধ করে থাকে তাহলে তার সাজাটা কীভাবে হবে। এখানে সব বিচারকের সাজার প্রশ্ন আসেনি। যিনি অপরাধ করেছেন তার সাজার বিষয় এসেছে।’

তিনি বলেন, ‘আমি যেটা বলতে চাই, ন্যাচারাল জাস্টিস বলে একটা কথা আছে। সেই ন্যাচারাল জাস্টিস ব্যাপারে বক্তব্য হল- আপনি আপনার বিচার করতে পারেন না।’

তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারের ইমপিচমেন্ট অপসারণ হয় সংসদে। আর আপনি বলছেন আমার বিচার আমি করবো।

তিনি বলেন, সংসদের কোন আইন যদি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে সেটা আদালত দেখতে পারে। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে মৌলিক কাঠামোর কোথায় হয়েছে সেটা প্রমাণ করতে হবে। ’৯৬ অনুচ্ছেদ আমরা প্রতিস্থাপন করেছিলাম। এটা বেসিক স্ট্রাকচারের কোথায় আঘাত করেছে আমরা দেখতে চাই।

আলোচনায় অংশ নেন সরকারি দলের সদস্য অধ্যাপক আলী আশরাফ, স্বতন্ত্র সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী, জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন বাবলু, বিএনএফ-এর আবুল কালাম আজাদ।

সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে স¤প্রতি আপিল বিভাগ রায় দিয়েছে। এর ফলে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতে ন্যস্ত হয়। ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রতিস্থাপিত করেছিল জাতীয় সংসদ। ওই সংবিধানের ৯৬ ধারা অনুযায়ী নৈতিক স্খলনজনিত কারণে বিচারপতিদের অপসারণ করতে পারতো সংসদ।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply