২০ এপ্রিল ২০২৪ / ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / রাত ১০:০৪/ শনিবার
এপ্রিল ২০, ২০২৪ ১০:০৪ অপরাহ্ণ

হযরত বদর আউলিয়া ও বার আউলিয়ার চট্টগ্রাম

     

লায়ন ডাঃ বরুণ কুমার আচার্য (বলাই)

 

হযরত বদর আউলিয়া, বদর পীর ও বদর উদ্দিন আলম ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত থাকলেও তিনটি নামেই আমাদের চট্টগ্রাম শহরের আবাদ করা সেই মহান মনীষী হযরত বদর আউলিয়া (রা.) এর নাম। তাঁর পবিত্র স্মৃতির চিহ্ন আমাদের চট্টগ্রামকে গৌরব উজ্জ্বল করে রেখেছে। চট্টগ্রামকে বদর পীরের চট্টগ্রাম বলা হয়। ইতিহাস গবেষণায় প্রমাণিত হযরত বদর আউলিয়া (রা.) জঙ্গল পাহাড় ডাকা এই চট্টগ্রামকে জিন, ভূত, পেরত তাদেরকে তাড়িয়ে মানুষ বসবাসের আবাসস্থল তৈরি করেন। মহান সাধক পীর হযরত বদর আউলিয়ার সেই চিহ্ন চট্টগ্রাম নগরীর প্রাণ কেন্দ্র চট্টগ্রাম চেরাগীপাহাড় এ বিদ্যমান। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এই স্মৃতির চিহ্নকে সংরক্ষণপূর্বক নান্দনিকভাবে দেখার জন্য আলোকসজ্জা ও সুর্ন্দয্য বর্ধন করেছেন। আরবী বছরের শাওয়াল মাসের নবম তারিখে এই মহান সাধক পুরুষের পবিত্র ওরশ মোবারক পালিত হয়। এ বছর ১৪৩৮ হিজরী ৯ শাওয়াল মঙ্গলবার মহাসমারোহে এই সাধক পীরের ওরশ শরীফ চট্টগ্রাম নগরীর বদরপাতিস্থ হযরত বদর পীরের মাজার সংলগ্ন মাঠে রাত-দিনব্যাপী কর্মসূচীর মধ্যে দিয়ে পালিত হবে। হযরত বদর পীর আউলিয়া (রা.) এর পবিত্র ওরশ শরীফে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনপূর্বক এই প্রবন্ধের মাধ্যমে হযরত বদর পীরের জীবন কর্ম ও বার আউলিয়ার শহর চট্টগ্রাম এর ইতিহাস তুলে ধরা হলো। আশা করছি এই প্রজন্ম হযরত বদর পীর ও বার আউলিয়ার শহর চট্টগ্রাম এবং প্রাচীন সময়ে চট্টগ্রামে মুসল আগমন সম্পর্কে তথ্য জেনে উপকৃত হবেন। বিশিষ্ট ইতিহাস গবেষক ও প্রাবন্ধিক সোহেল মুহাম্মদ ফখরুদ-দীন তাঁর রচিত চট্টগ্রাম মুসলমান আগমনের ইতিকথা গ্রন্থের প্রথম সংস্করন ২০১৫ তে লিখেছেন, “নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) মক্কায় ইসলামের দাওয়াত শুরু করায় মক্কার শাসক গোষ্ঠি কুরাইশরা তাঁর উপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন শুরু করে। অত্যাচারী কুরাইশরা ততোধিক নির্মম নির্যাতন-নিপীড়ন শুরু করে ইসলামের আহবানে সাড়া দেওয়া নবদীক্ষিত মুসলিমদের উপর। মক্কায় তাঁদের জীবন সংকটাপন্ন হয়ে উঠলে আল্লাহর রসূল (সা) তাঁদেরকে আবিসিনিয়ায় (ইথিওপিয়া) গমন করে আত্মরক্ষার অনুমতি দান করেন। সাহাবারা দুই দলে বিভক্ত হয়ে আবিসিনিয়ায় গমন করেন। ৬১৩ খ্রিস্টাব্দে ১১ জন পুরুষ ও ৪ জন মহিলা সাহাবী প্রথম ব্যাচে আরবের সুহাইবা বন্দর থেকে আবিসিনিয়ার অক্সামে গমন করেন। আবিসিনিয়ার খ্রিস্টান রাজা আমা ইবনে আবজার (আল নাজাসী, নেগুস) তাঁদেরকে সাদরে বরণ করেন। দুই বছর পর ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে হযরত আলীর (রা) কনিষ্ঠ ভ্রাতা জাফর ইবনে আবু তালিব (রা)- এর নেতৃত্বে প্রায় একশ সদস্যের অপর একটি দল (৮৩ জন পুরুষ, ১৮ জন মহিলা) আবিসিনিয়ার অক্সামে পৌছান। ৬১৩ ও ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে আবিসিনিয়ায় আশ্রয়গ্রহণকারীদের মধ্যে নবী করীম (সা) এর বিশিষ্ট কয়েকজন সাহাবা ছিলেন, যথা- সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা), আবদুল্লাহ ইবনে জাস (রা), উসমান ইবনে আফ্ফান (রা), (পরবর্তীকালে খোলাফায়ে রাশেদিনের তৃতীয় খলিফা) ও তদীয় স্ত্রী রুকাইয়া বিনতে মুহাম্মদ (সা) প্রমূখ। পরবর্তীকালে সাহাবারা আবিসিনিয়া থেকে মদিনায় ফিরে যান। কিন্তু সেই ৬১৫ খ্রিস্টাব্দেই সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা) অপর দুইজন সঙ্গী নিয়ে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে ইথিওপিয়ার অক্সাম বন্দর থেকে নৌপথে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌছান। তিনিই প্রথম চট্টগ্রামবাসীদের নিকট ইসলামের বাণী পৌছে দেন। চট্টগ্রাম থেকে কামরূপ-মণিপুর হয়ে ৬১৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি চীনের ক্যান্টন শহরে উপনীত হন। ক্যান্টন ও পার্শ্ববর্তী এলাকার হুই চাই (পরবর্তী কালে হুই হুই জনগোষ্ঠি নামে পরিচিত) জনগণের মধ্যে ইসলাম প্রচারের পর ৬৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি আরবে ফিরে যান। এভাবে হযরত মুহাম্মদ (সা) এর প্রিয় সাহাবী সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা) এর মাধ্যমে ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে উপমহাদেশে চট্টগ্রাম সর্বাগ্রে ইসলামের অমিয় বাণীর সন্ধান পায়। অতঃপর কামরূপ ও মণিপুর। তারপর চীন। সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা) ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। ৬১০-৬১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং রসূল (সা) এর প্রিয় সাহাবায় উন্নীত হন। ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ১৭তম ব্যক্তি। তিনি হযরতের মাতা আমিনা বিনতে ওয়াহাব (রা) এর চাচাত ভাই ছিলেন। তিনি সুদক্ষ সেনাপতি ছিলেন। পারস্য সাম্রাজ্য (ইরান) বিজয়ে নেতৃত্ব দান করেন। ৬৩৭-৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি পারস্য সম্রাজ্যের রাজধানী টেসিফন এর গভর্নর এবং ৬৪৫-৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়ার বুসরা আল শাম এলাকার গভর্নর ছিলেন। সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা) আরব-চীন কূটনীতির পুরোধা হিসাবে ইতিহাসে খ্যাত হয়ে আছেন। ক্যান্টনে তাঁর স্মৃতি সংরক্ষিত আছে। চট্টগ্রামকে বলা হয় বার আউলিয়ার চট্টগ্রাম। আবার এও বলে যে, পীর বদর আউলিয়ার চট্টগ্রাম। যখন যেভাবেই বলা হোক না কেন ইতিহাসে পবিত্র ইসলামের মর্মবাণী প্রচার-প্রসার এবং মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠায় অগ্রগামী ব্যক্তিত্ব হিসেবে বদর পীরের অবদান অপরিসীম। হযরত বদরপীরকে চট্টগ্রামের অভিভাক পীর বা দরবেশ হিসেবে চিহিৃত করা হয়। বলা হয় তিনিই চট্টগ্রামের প্রথম মুসলিম মিশনারী। জ্বীন বা দৈত্য থেকে এক চাটি পরিমান জায়গা ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে আগুন জ্বালিয়ে ঐ জায়গায় পবিত্র আজান ধ্বনির মাধ্যমে পবিত্র ইসলামের বানী প্রচারে নিমগ্ন হন। তিনি যে চট্টগ্রামে প্রথম মুসলমান মিশনারী এ নিয়ে ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের মতবিরোধ রয়েছে। চট্টগ্রাম-সাগর-নদী-পাহাড়ঘেড়া অঞ্চল। বহুমাত্রিক এ চট্টগ্রামে নামেরও বৈচিত্র্য রয়েছে। বহুমাতিত্রক এ চট্টগ্রামে নামেরও বৈচিত্র্য রয়েছে। এদেশ যখন বঙ্গপণ্ডু তখন কিরাত (চট্টগ্রাম) এ অঞ্চলের নাম। ইতিহাসবিশারদ পন্ডিত আবদুল হক চৌধুরী মহাভারতীয় ‘কিরাত’ অঞ্চলকে চট্টগ্রামের ভূখন্ড হিসেবে চিহিৃত করেন। প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধ এ জনপদ চট্টগ্রাম। সাগরকূলের এ মানুষের এক সময় জীবন-জিবিকার পথ ছিল সাগর-নদী। মাঝি-মাল্লারা ধর্মীয় দৃষ্টিতে জ্বলে-জংগলে যেতে তারা পীর-মুরশিদকে স্মরন করত অতি শ্রদ্ধা আর পূর্নময় আশায়। সেই প্রাচীন সময় থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষ নানান গীতে চট্টল অভিভাবক পীর বদর শাহ্কে স্মরন লক্ষ্যনিয়। ॥গীত॥
আমরা আছি পোলাপাইন,
গাজী আছে নিকাবাইন,
শিরে গঙ্গা দরিয়া-
পাঁচ পীর! বদর, বদর, বদর”।
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাস বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. আবদুল করিম-চট্টগ্রামে মুসলিম শাসন শিরোনামে প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন “চট্টগ্রাম বার আউলিয়ার দেশ, অর্থাৎ জনগন বিশ্বাস করে যে, বারজন অলি-দরবেশ সর্বপ্রথম চট্টগ্রামে এসে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। কবি মুহাম্মদ খানের সাক্ষ্য এই জনশ্র“তির ঐতিহাসিকতা স্বীকার করতে সাহায্য করে, যদিও কবি বারজন অলি দরবেশের নাম লিখেননি। শুধু মাতৃকুল পরিচয় দিতে গিয়ে কবি তাঁর পূর্বপুরুষ শায়খ শারীফ-উদ-দীনের নাম উল্লেখ করেছেন যিনি কদল খান গাজীর “প্রেমের সখা” ছিলেন। অর্থাৎ বার আউলিয়ার অন্যতম ছিলেন। পরে পিতৃকুল পরিচয় দিতে গিয়ে কবি বদর আলমের নাম উল্লেখ করেছেন, তিনিও বার আউলিয়ার অন্যতম ছিলেন। কবি বলেন যে, তাঁর পূর্ব পুরুষ মাহি আছোয়ার যখন হাজী খলীল পীরকে সঙ্গে নিয়ে আরব দেশ থেকে চট্টগ্রামে আগমন করেন, চট্টগ্রামে কদম খান গাজী এবং শাহ বদর আলমের সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎ হয়। সুতরাং মুহাম্মদ খানের বংশ পরিচয়ে চট্টগ্রামের বার আউলিয়ার মধ্যে তিনজনের (অর্থাৎ কদম খান গাজী, শায়খ শরীফ-উল-দীন ও বদর আলম) নাম পাওয়া যায়। সোনার গাঁও এর সুলতান ফখর-উদ-দীন মুবারক শাহ্ মুসলমানদের মধ্যে সর্ব প্রথম চট্টগ্রামে মুসলিম শাসন প্রতিষ্টা করেন। কদম খান গাজী এবং বদর আলম তাঁর সমসাময়িক। জনশ্র“তি মতে কদম খান গাজী- সুলতান ফখর-উদ-দীন মুবারক শাহের সেনাপতি ছিলেন। চট্টগ্রামে বদর পীরের প্রভাব এখনও বর্তমান। এখানে পীর বদর আলমের সমাধি ভবন আছে, ঐ এলাকা বদর পাতি নামে পরিচিত। বদর পীরের চাটির কথা এখনও সকলে ভক্তি ভরে স্মরন করে থাকে এবং কোন কোন লেখকের মতে বদর শাহের চাটির নামানুসারে চট্টগ্রামের নাম চাটিগ্রাম হয়। আবার কোন কোন লেখক মনে করেন যে, চট্টগ্রামের বদর শাহ্ ও বিহারের ছোট দরগাহে সমাহিত পীর বদর উদ-দীন-বদর-ই-আলম এক ও অভিন্ন। বিহারের পীর বদর ১৪৪০ খ্রিস্টাব্দে পর লোকগমন করেন। সুতরাং এই লেখকদের মতে বদর শাহ্ সুলতান ফখর-উদ-দীন মুবারক শাহের সমসাময়িক নন। কিন্তু চট্টগ্রামের বদর পাতিস্থ বদর শাহের সমাধিভবন পরীক্ষা করে আমাদের মনে হয়, বদর শাহ্ চট্টগ্রামেই সমাহিত আছেন। বদর পাতিস্থ মাজার নেহায়েত জওয়াব বা কৃত্রিম সমাধি নয়। বিহারের ছোট দরগাহে সমাহিত পীর বদরের সঙ্গে চট্টগামের পীর বদরের কোন সম্পর্ক নেই। একই নামধারী ভিন্ন ভিন্ন লোক থাকতে পারেন” চট্টগ্রামের ইসলামী ঐতিহ্য, আবদুল করিম, পৃষ্ঠা ৮ ও ৯, প্রজ্ঞালোক প্রকাশনী, ২০০২। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রফেসর ডঃ মুুুুুুুুুুুুুুুুুহাম্মদ এনামুল হক হযরত বদর পীর সম্পর্কে লিখেন “বাংলাদেশ নদী মাতৃক। জলপথে যাত্রা কালে বিপদমুক্তির জন্য এ দেশের মাঝি-মাল্লা কর্তৃক জলসম্পৃক্ত কোন না কোন পীরের দোয়া মাগা অত্যন্ত স্বাভাবিক। চট্টগ্রাম ও ইহার সন্নিহিত জেলা সমুহের মাঝি মাল্লাদের আশ্রয়দাতা বলিয়া স্বীকৃত ‘পীর-বদরকে’ ও একদা ‘পীর পঞ্চকের’ তালিকাভুক্ত করিয়া নওয়া হইয়াছিল। তাই দেখিতে পাই, বিশালকার নদী পাড়ি দিতে গিয়ে অথবা সমুদ্রের দীর্ঘ ও বিপদসস্কুল পথে যাত্রা কালে এই বিশাল অঞ্চলের নাবিকগন এখনও প্রায়ই একটি লৌকিক ‘দোয়া’ বা ‘মন্ত্র’ বিড়-বিড় করিয়া উচ্চারন করিয়া থাকে, এবং তাহা এই রূপঃ
“আল্লা, নবী, পাঁচ পীর,
বদর, বদর বদর”।
অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ্! আমরা আমাদের এই যাত্রালগ্নে তোমার করুনা ভিক্ষা করিতেছি ও রসুলের আশিস প্রার্থনা করিতেছি; এবং হে পাঁচ পীর, তোমাদের সকলকে বিশেষ করিয়া, তোমাদের নেতৃস্থানীয় পীর বদরকে তিন সত্য দিয়া আহবান করিতেছি। তোমরা আমাদের সহায় হও’। বাংলাদেশের মাঝি-মাল্লাদের মধ্যে পীর পঞ্চকের এইরূপ বেশ কতিপয় তালিকা পাওয়া যায়। তন্মধ্যে একটি এরূপঃ ১) শাহ বদর (বদর আলম), ২) শাহ সুলতান (সুলতান বায়েজিদ বোস্তামী), ৩) শাহ্ জলাল (মুজর্রদ-ই-য়মনী), ৪) শাহ্ মুহসীন আউলিয়া, ৫) শেখ ফরিদ। কখনও কখনও শাহ্ পীরকে শাহ মুহসিনের স্থলাভিষিক্ত হইতে দেখা যায়। তাহারা সকলেই ঐতিহাসিক দরবেশ এবং তাহাদের দরগাহ্ বা আস্তানাগুলির সব কটিই বাংলাদেশে অবস্থিত। বদর শাহেব (১৩৩৬-১৩৫২) দরগাহ চট্টগ্রাম শহরের বকশী বাজারে অবস্থিত। সুলতান বায়েজিদ বোস্তামীর জীবনকাল (৭৭৭-৮৭৪) কৃত্রিম সমাধিটি চট্টগ্রাম শহরের ৬ মাইল উত্তরে নাসিরাবাদে স্থাপিত। শাহ জালাল যমনীয় (মৃত্যু- ১৩৪৬) সমাধি ও দরগাহ্ শ্রীহট্রে (সিলেট), শাহ মুহসিন আউলিয়া (মৃত্যু ১৩৯৭) চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা থানার বটতলী গ্রামে দরগাহ রূপে সম্মানিত এক পর্নকুটীরে চিরশায়িত। শেখ ফরিদের (জীবন কাল ১১৭৬-১২৬৯) ‘চশমা’ (ঝর্না) চট্টগ্রাম এবং ফরিদপুর শহরে তাঁহার কৃত্রিম সমাধি। এতদ্ব্যতীত, সুদীর্ঘ ও বিপজ্জনক নদী অথবা সমুদ্রযাত্রার প্রাক্কালে ঢাকা ও ময়মনসিংহের হিন্দু, মুসলমান মাঝিরা সম্ভাব্য বিপাক এডাইবার জন্য আরও একটি লোকিক মন্ত্র উচ্চারন করিয়া “ঘাজিমিঞা” ও পাঁচ পীরের প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন করিয়া থাকে। মন্ত্রটি এরূপঃ
আমরা আছি পোলাপাইন,
গাজী আছে নিকাবাইন,
শিরে গঙ্গা দরিয়া
পাঁচপীর! বদর, বদর, বদর।
অর্থাৎ ঃ আমরা সকলেই তাহার সন্তান-সন্তত; খাজী মিঞা হইতেছেন আমাদের ‘নিগাবান’ বা রক্ষা কর্তা; সমুদ্রের ন্যায় ভয়ংকর নদীতে (গঙ্গায়) পাড়ি জমাইবার জন্য আমাদের সম্মুখে অনন্ত জলরাশি সম্প্রসারিত হইলেও আমরা ভয় করিনা। হে পাঁচ পীর! আমরা সকলেই তোমাদের সকলকে সমষ্টিগত ভাবে, বিশেষ করিয়া, তোমাদের নেতা পীর বদরকে আহবান করিতেছি। মুহাম্মদ এনামুল হক রচনাবলী, ৩য় খন্ড, মনীষা মঞ্জুষা, পৃষ্ঠা ৮২৩, ৮২৪, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৪। চট্টল গবেষক খ্যাত- প্রখ্যাত ইতিহাস বিশারদ পণ্ডিত আব্দুল হক চৌধুরী লিখেছেন, “চতুর্দশ শতকে আরব থেকে সমুদ্রপথে বদর শাহ্ ও হাজী খলিল পীর ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম আগমন করেন। তাদের আগমনের কিছুকাল পর ১৩৪০ খ্রীষ্টাব্দে সোনার গাঁর সুলতান ফখর-উদ-দীন মুবারক শাহ্ প্রথম চট্টগ্রামকে মুসলিম শাসনভূক্ত করেন। বদর শাহ্ ও হাজী খলিল পীর সুলতান ফখর-উদ-দীন মুবারক শাহ কে চট্টগ্রাম বিজয়ে সাহায্য করেছিলেন। তখন থেকেই সত্যিকার ভাবে ইসলাম প্রচার এখানে আরম্ভ হয়েছিল। চট্টগ্রামে সুফী সাধকরাই ইসলাম প্রচার করেন। শাহ্ মসনদ বা শাহ পীর, শরীফুদ্দিন পীর জাদা, আবদুল ওয়াহাব শাহ ভিখারী, শাহ জায়েদ, শাহ পস্থী প্রমুখ আরব, ইরান, মধ্য এশিয়া ও উত্তর ভারতের সুফী সাধকরাই চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচার করেন” চট্টগ্রামের সমাজও সংস্কৃতির রূপরেখা, পৃষ্ঠা ৩৬ ও ৩৭, বাংলা একাডেমী, মে ১৯৮৮। আবদুল হক চৌধুরী চট্টগ্রাম চার অভিভাবক দরবেশ শিরোনামে ‘‘বদর শাহ” এতে তিনি লিখেছেন, “সিহাবুদ্দিনের তালিশের বিবরনেও পীর বদরের আস্তানার কথা উল্লেখ আছে এবং তৎজন্য মঘারাজা প্রদত্ত ভূমিদানের কথা ও আছে। সম্ভবত সাহা ফিরুজ খাঁ কোন মঘ বাজার মুসলমানী নাম চট্টগ্রামের প্রাচীন ইতিহাস ও মুসলমান আগমন এ অঞ্চলে মুসলিম প্রচার প্রসার নিয়ে কে আগে এসেছে এনিয়ে মত বিরোধের কারনে আমরা মুসলিম ইতিহাস অনেক পিছু পড়ে আছি। আধুনিক সভ্যতার এ যুগে এসেও আমাদের ধারনা ভিত্তিক ইতিহাস নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। প্রাসঙ্গিক বিষয়ে ঢাকা দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গবেষক ফরিদ উদ্দিন খান সুফী সাধকের বাংলাদেশ প্রবন্ধে- ইসলামের প্রথম যামানার সময়কাল থেকেই যে এদেশে ইসলাম প্রচারক আরেক ওলি ও বনিকগনের বাংলায় প্রথম দিকে আগমনের তথ্য দিয়েছেন। তিনি বাংলার চার ভাগে ভাগ করে সুফিগণ ধর্ম প্রচারে ঢ়ুকে পড়েন বলে তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেন। বাংলার দক্ষিন অঞ্চলে সমুদ্র পথে, পশ্চিম অঞ্চলে স্থল পথে এবং মধ্য, পূর্ব ও উত্তর অঞ্চলে নদী পথে সুফী- সাধকগন ছড়িয়ে পড়েন। এসব সুফী-সাধক ও আউলিয়া কেরামগন বেশির ভাগই ফার্সী ভাষী, আউলাদে রাসুল তথা সৈয়দ। বাংলার দক্ষিন পশ্চিম অঞ্চলে হযরত খান জাহান আলী, দক্ষিন পূর্ব অঞ্চলে হযরত বদরপীর, মহসিন আউলিয়া, সোলতান বায়েজিদ বোস্তামী, কদম শাহ ও শাহ আমানত, পূর্ব অঞ্চলের কেল্লা শহীদ সৈয়দ আহমদ গেছু-দেরাজ, নাসির উদ্দিন সেপাহসলার, বন্দেগী শাহ্, উত্তর পূর্ব অঞ্চলের হযরত শাহজালাল (রাঃ), হযরত শাহ্ পরান (রাঃ), বুরহান উদ্দিন (রাঃ), গুলজারে আলম, উত্তর অঞ্চলে শাহ মাহী সওয়ার, শাহ্ জামাল (রাঃ), শাহ কামাল (রাঃ), শাহ্ মখদুম (রাঃ), মধ্য অঞ্চলে বাবা আদম শাহীদ, বাবা ওলী বাংলা শরফুদ্দীন চিশতী (রাঃ), শাহ্ আলী (রাঃ) পীর ইয়ামেনী, শাহ নেয়ামত বুতশোকাম প্রমুখ সুফী, দরবেশগণ পবিত্র ধর্ম ইসলাম প্রচার-প্রসারে অসামান্য অবদান রেখেছেন। সময়ের ব্যবদানে পশ্চিমা আরব সুফী, দরবেশ এবং সাহাবী ও তাবিয়ী পর্যন্ত বাংলার জমিনে ইসলাম প্রচার করেছেন। আজকের সময়ে ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের মেধাযুক্ত গবেষনায় আস্তে আস্তে ইসলামী ইতিহাস প্রজন্মের কাছে উঠে আসবে। চট্টগ্রামকে পীর বদরের চট্টগ্রাম বলা হয়। আগেই উল্লেখিত হয়েছে তাঁর আমল থেকে সর্বসময় তিনি প্রভাব বিস্তারকারী ছিলেন। চট্টগ্রামের দুজন সুফী অলিকে বলা হয় পানি ভাসা আউলিয়া। জনশ্র“তি মতে বদরপীর ও শাহ মোহসীন আউলিয়া পাথর ভেসে নদী সাগর পার হয়ে এ অঞ্চলে এসেছে বলে- তাঁদের পানি ভাসার আউলিয়া বলেন”। বার আউলিয়ার এই চট্টগ্রামের প্রভাব বিস্তারকারী মহান সাধক পুরুষ-যোদ্ধা হযরত বদর আউলিয়ার পবিত্র স্মৃতি চিহ্ন গুলো ক্রমান্নয়ে ধ্বংস হতে চলেছে। কক্সবাজার-চকরিয়ার বদর আউলিয়ার স্মৃতির চিহ্ন বদর মোকাম আজ ধ্বংসের প্রহর গুনছে। আমাদের সচেতনতার অভাবে এই সমস্ত প্রাচীন প্রতœ সম্পদের তালিকায় এখনও নাম উঠাতে পারিনি। সরকারীভাবে হযরত বদর আউলিয়ার মাজার, স্মৃতির চিহ্ন বদর মোকাম, বদর আউলিয়ার ব্যবহারিত প্রাচীন কিস্তি, পাথর, চেরাগ ও অন্যান্য সমগ্রী স্থায়ী রূপে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এই বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটিকর্পোরেশন, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহন করতে পারে। সাধারণ নাগরিক ও ইতিহাস সচেতন ব্যক্তিগন এই বিষয়টির ব্যবস্থাগ্রহনের জন্য সরকারের নিকট জোর দাবী জানান।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply