২০ এপ্রিল ২০২৪ / ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / সকাল ৬:৪৫/ শনিবার
এপ্রিল ২০, ২০২৪ ৬:৪৫ পূর্বাহ্ণ

একুশে ফেব্রুয়ারি অন্তহীন প্রেরণার উৎস

     

 

আবছার উদ্দিন অলি

একুশে ফেব্রুয়ারি স্বাধীনতা, মুক্তি, সাম্য, গণতন্ত্র-আধুনিক বাঙালির সব শুভ চেতনার মাস। তার পর আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারির মিলেছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এই দিবসটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও বটে। মাতৃভাষা বাংলার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের মহিমা ছড়িয়ে পড়েছে ভৌগলিক সীমারেখা অতিক্রম করে পৃথিবীর সব জাতি-গোষ্ঠীর মাতৃভাষার স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে। সত্য, ন্যায়, শান্তি ও গণতন্ত্রের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের দৃঢ় অঙ্গীকারের বার্তা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয় এই দিনে। সবার সব পথ এসে মিশে গেছে শহীদ মিনারে। কন্ঠে ছিল সেই চির চেনা বিষন্ন সুর। অনুপ্রাণিত ভোরের হাওয়ায় মর্যাদা সুমন্নত রাখতে বাংলা মায়ের বীর সন্তানদের বুকের রক্ত ঢেলে রাজপথ রাঙিয়ে দেওয়ার দিন অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। একুশ মানেই মাথা নত না করা। একুশ মানেই আন্দোলন, সংগ্রাম, প্রতিরোধ।

ভাষা আন্দোলনকে বলা হয় আমাদের জাতীয় চেতনার উন্মেষলগ্ন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ এই ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই নিহিত ছিল। রাষ্ট্রভাষার দাবি ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরায় পরিণতি লাভ করে ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্যে। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত আমাদের ইতিহাসের তন্নিষ্ঠ পাঠ গ্রহণের জন্য তাই বায়ান্নর একুশে ফ্রেব্রুয়ারির পটভূমি ও তাৎপর্য উপলব্ধির বিকল্প নেই। জাতির ভবিষ্যৎ পথের দিশা নিতেও আমাদেরকে বারবার একুশের আন্দোলনের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। আমাদের জাতীয় উন্মেষের ইতিহাসের সঙ্গে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির লড়াই ও আত্মত্যাগের ঘটনা একাকার হয়ে আছে।

১৯৫২ থেকে ২০১৯ ছয় দশকের এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আমরা দেখলাম, একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের অন্তহীন প্রেরণার উৎস। সেই ফেব্র“য়ারির ২১ তারিখে বাঙালি তরুণেরা মাতৃভাষার মর্যাদার দাবিতে ঢাকার রাজপথে যে রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন, এই ফেব্র“য়ারির সেই রক্তেরই ডাক শুনেছে সমগ্র বাংলাদেশ। মাতৃভাষার দাবিতে বাঙালি তরুণদের সেদিনের আত্মবলিদান শুধু ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, ক্রমেই একটি গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন ও অঙ্গীকার দানা বেঁধেছিল। সে স্বপ্নই স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আমাদের পথ দেখিয়েছে।

একুশকে নিয়ে বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে নানা শিল্প ও সংস্কৃতিকর্ম এবং গ্রন্থপ্রকাশনা ও গ্রন্থমেলা। সংগীত ও সাহিত্যে, নাটক ও চলচ্চিত্রে এবং বিবিধ চিত্র ও শিল্পকলায় একুশের অনুপ্রেরণা ও প্রভাব আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। শিল্পে, সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে দ্রোহ ও সৃজনশীলতার সূচনা করে আমাদের জীবন চলাকে আরও সুন্দর ও নান্দনিক করার সুযোগ এনে দিয়েছিল ভাষা আন্দোলন। সব শ্রেণির মানুষকে প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে দিয়ে এক সুদূরপ্রসারী জাতীয় চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছিল একুশে। ঐক্যবদ্ধ মানুষের এই অগ্রযাত্রা একটি জাতি তৈরির সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল বায়ান্নতে। তবে ‘বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার দাবি একুশের প্রধান আওয়াজ হলেও এর পেছনে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের প্রশ্ন এবং এসব ক্ষেত্রে আশাহত হওয়ার পরিচয় জড়িয়ে ছিল’। সে অর্থে ভাষা আন্দোলনকে নিছক এক সাংস্কৃতিক ঘটনা হিসেবে দেখা মোটেই ঠিক হবে না। এর পেছনে গভীর অর্থনৈতিক কার্যকারণ ছিল। মূলত অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বিকাশের সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় সব শ্রেণির মানুষ ভাষা আন্দোলনে যোগ দেয়। শহীদ মিনার হয়ে আছে আমাদের সংগ্রামের সাথী।

যুগের হাওয়া বাংলা ভাষার উপরে আকাশ সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে। এর মূল কারণ জাতিগতভাবে আমাদের মানসিকতা এখনও পরিবর্তন ঘটেনি। আমরা সবকিছুতে নিজেদের কু-রুচিপূর্ণ মনোভাবকে জাগিয়ে তুলছি। শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিনোদন কিংবা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় এমনকি ব্যক্তি জীবনেও ভাষার ব্যবহারকে যেনতেন ভাবে উপস্থাপন করে চলেছি। এক্ষেত্রে আকাশ সংস্কৃতির অশুভ প্রতিযোগিতা আমাদেরকে চরম ভাবে আঘাত করছে। অন্য ভাষার প্রতি আসক্তি বাড়িয়ে তুলেছে আকাশ সংস্কৃতির বিশ্বব্যাপী অসুস্থ প্রতিযোগিতা। চাকচিক্য ও বাহারি রূপ, রং ও অন্য ভাষার প্রতি বেশি কর্তৃত্ব দেখাতে গিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলছি নিজের অজান্তে। এই আগ্রাসন শুরু অনেক বছর থেকে। একে রোধ করার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আকাশ সংস্কৃতির উপর গুরুত্ববহ নীতিমালা প্রয়োজন। যা করতে হবে রাষ্ট্রীয় ভাবে।

সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষ এগিয়ে যাবে তা দোষের কিছু নয়। তবে নিজস্ব সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে নয়। আকাশ সংস্কৃতির ভালদিকটা গ্রহন করবো, মন্দদিকটা বর্জন করবো। এই মানসিকতা জন্ম নিলে তখনই মঙ্গল বয়ে আনবে। নয়তো ভাষার প্রতি চরম অবহেলা ও অপমান হবে। অবহেলিত হবে বাংলা ভাষা। ভাল কিছু জানা থেকে, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে তরুন প্রজন্ম। তথ্য প্রযুক্তিরযোগে পৃথিবীকে জানা কঠিন বিষয় নয়, তবে সে জানার মধ্যে শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং দেশীয় মূল্যবোধ থাকতে হবে। মাতৃভাষাকে সম্মান জানানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কারণ মায়ের ভাষার প্রতি আমাদের আদর-কদর সবার আগে থাকতে হবে। কে, কি করলো, কে, কিভাবে চললো সেটি আমাদের বিষয় নয়। ভাষাকে বিকৃত না করায় আমাদের আদর্শ হওয়া উচিত। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব থাকবে, তাই বলে মন্দ নিয়ে লাফালাফি কেন করবো। আমাদের সম্মিলিত প্রয়াসে এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব। কেননা, ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধে শহীদের তাজা রক্ত আর আত্মত্যাগ আমাদেরকে সব অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার অনুপ্রেরণা যোগায়।লেখক: সাংবাদিক ও গীতিকার

 

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply