২০ এপ্রিল ২০২৪ / ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / দুপুর ১২:১৭/ শনিবার
এপ্রিল ২০, ২০২৪ ১২:১৭ অপরাহ্ণ

সেবা খাত গুলোর বেহাল দশায় প্রশ্নবিদ্ধ গ্রাহক সেবা

     

 

এস এম মনসুর নাদিম

লেখাটি শুরু করার আগে পাকিস্তানের উর্দু কবি ডঃ আল্লামা ইকবালের একটি কবিতার দুটি লাইনের উদ্ধৃতি দিতে চাই। কারণ ওই লাইন দুটি বাংলাদেশের জন্য অত্যান্ত সময়োপযোগী। ইকবাল বলেছেন-‘হার শাঁখ মে উল্লু বেইঠা, তো আঞ্জামে গুলিস্তাঁ কিয়া হোগা’ ? (বাগানের প্রতিটি শাখায় বাদুড় বসলে বাগানের পরিণতি কী হবে ?) অযোগ্য অদক্ষ ও অথর্বদের দিয়ে সেবাখাত চলেনা। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিতে ডুবে থাকাদের নিয়ে উন্নয়নের রথযাত্রা কখনো সফলতার মুখ দেখেনা। কয়েক মাস আগের পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল জনৈক ব্যক্তি ঘুষ খোরের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করতে গেলে উল্টো ঘুষ দিয়ে প্রানে বেঁচে বেরিয়ে এসেছিলেন। স্বীকার করুন আর না করুন সত্যি আমরা বড় খারাপ সময় পার করছি। শতকরা পঁচানব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে আমরা ঘুষ, সুদ, অনিয়ম ও দুর্নীতিতে গলা পর্যন্ত ডুবে আছি।

অজুহাত এমন একটি হাত যার শক্তি অপরিসীম। মানুষ সচরাচর অন্যকে ধোঁকা দেয়ার জন্য এই অজুহাত বা বাহানা’র আশ্রয় নেয়। তাই বলা হয়, যেই হাতের কোন জুড়ি নেই সেই হাতের নাম ‘অজুহাত’। উন্নয়নের জোয়ারে ভাসা ডিজিটাল বাংলাদেশের সরকারী সেবা খাত গুলোতেও এই ‘অজুহাত’র চরম অপব্যাবহার হতে দেখা যায়। বিদ্যুৎ সংকট এর জন্য বিগত সরকারগুলোকে দোষারোপ করলেও বর্তমানে বিদ্যুতের সংকট পুরোপুরি কাটেনি। বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিলও নানা অনিয়ম দুর করতে পারেনি। দায়িত্বশীলদের এই ব্যপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তারা চর্বিতচর্বন যেই মুখস্থ সংলাপটি বলেন তা হল-‘এই দীর্ঘদিনের জঞ্জাল রাতারাতি দুর করা সম্ভব না’। অর্থাৎ আগেও ঘনঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়েছে এখনো হচ্ছে। চোখে পড়ার মত কোন পরিবর্তন আসেনি। পরিবর্তন যদি কিছু এসে থাকে তবে তা পরপর বিদ্যুৎ বিল বৃদ্ধি করা ব্যতীত অন্যকিছু নয়। প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা বিদ্যুৎ গায়েব। স্থানীয় অফিসে ফোন করলে বেশিরভাগ সময় ফোনটা ব্যস্ত করে রাখা হয়। কদাচিৎ কাউকে পেলেও জবাব আসে ‘কাজ করতেছে’। প্রতি শুক্রুবার বা সরকারী ছুটির দিনগুলিতেও দিনের বেশিরভাগ সময় বিদ্যুৎ বন্ধ করে রাখা হয়। জবাব একটাই-‘কাজ চলতেছে’। কাজ চলতেছে কিংবা কাজ করতেছে শুনলে ভালো লাগার কথা। যাক বাবা অন্তত কেউ না কেউ তো কাজ করতেছে। আমরা জানি এইদেশে কাজের লোক বিরল হলেও কথার লোকের অভাব নেই। কিন্তু খুশি হতে পারিনা। কারণ, প্রত্যেহ বিনা নোটিশে কাজ করার অজুহাত দেখালেও কাজের কাজ কিছুই তো হচ্ছেনা। মাসের পর মাস কাজ (মেরামত) করেও অবস্থা তথৈবচ। এইদেশে মানুষেরা বর্ষা মওসুম এলেই ঘর মেরামত করে থাকে। সাং বৎসর নাকে তেল দিয়ে ঘুমোলেও বর্ষায় তারা নড়েচড়ে ওঠে। গ্যাস, টি এন্ড টি, ওয়াসা ও বিদ্যুৎ এর ক্ষেত্রেও তাই। তারাও রাস্তা খোঁদা-খোদিতে বর্ষা কালটাকেই বেছে নেয়। মজার ব্যাপার হল, এই তিন/চারটি সরকারি সংস্থা একই এলাকায় খোঁদা খোদি করলেও নিজেদের মধ্যে কোন যোগাযোগ কিংবা আলাপ-আলোচনা না থাকাই কাজের গতি ও স্বেচ্ছাচারিতায় রাস্তা কর্দমাক্ত যানজট সহ বিশ্রী জনদুর্ভোগের সৃষ্টি হয়। সরকারি কাজ বিদেশেও হয়, কিন্তু সেখানে অত্যান্ত দক্ষতা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে সব কিছু হয়। যা আমাদের এখানে দুর্লভ। মজার ব্যাপার হচ্ছে যেই বাঙালি শ্রমিকেরা বিদেশের মাটিতে সুশৃঙ্খলভাবে অত্যান্ত সুনিপুণ ভাবে কাজে দক্ষতার পরিচয় রাখে, সেই একই শ্রমিক বাংলাদেশে এসে কেন তা পারেনা।

গবেষণা ও অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বিদেশে কাজের একটা পদ্ধতিকে অনুসরণ করা হয়।এবং সংশ্লিষ্টদের পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের কোন বিকল্প নেই। সেখানে উচ্চপদস্থ যারা আছেন, তাদেরকে ঘুষ দিয়ে বশ করা যায়না। ওপরে যেহেতু কেউ ঘুষ খায়না সেহেতু নীচের কেউ সেই সাহস করেনা। শিক্ষিত ও সংশ্লিষ্ট কাজে প্রশিক্ষিত লোকেরাই শ্রমিকদের কাছ থেকে কাজ আদায় করে নেয়। ওখানে কাজ ফেলে কেউ বিলাসিতা করেনা। কোটি টাকা ব্যয় করে কেউ সদলবলে প্রশিক্ষনের নামে বিদেশ সফর করেনা। কারণ ওখানে নিয়োগ ও পদোন্নতি দুটোই যোগ্যতার ভিত্তিতে তর্কমুক্ত স্বচ্ছ।আমাদের জনদুর্ভোগের প্রথম ও প্রধান কারণ হল-পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের অভাব। অন্যান্য কারনের মধ্যে রয়েছে, অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং নিয়োগ/পদোন্নতির ক্ষেত্রে ঘুষ, স্বজনপ্রীতি ও স্বচ্ছতার অভাব। গত এপ্রিলের শেষ সপ্তাহের সুপ্রভাত পত্রিকার সুত্রে জানতে পারলাম-নগরীর বাকলিয়া এলাকায় তিন দিন ধরে পানি নেই। বৈশাখের তাপদাহ গরমে কোথাও তিন দিন পানি না থাকলে সেখানে ভয়াবহ কারবালা সদৃশ। একটা সেবামূলক সংস্থা থেকে এই ধরনের অপ্রত্যাশিত কারবালা সদৃশ ঘটনা কেউ আশা করেনা। তারপরও তা ঘটেছে। ওয়াসার পানিতে কেঁচো, শ্যাওলা ও দুর্গন্ধযুক্ত ময়লার অভিযোগেরও কোন কমতি ছিলনা। গ্রাহকেরা পানি পায়না, ওয়াসার পানি বিক্রি করে ওয়াসার চতুর্থশ্রেনীর কর্মচারীরা সম্পদের পাহাড় গড়েছে বলেও পত্রিকায় শিরোনাম হয়। কয়েকমাস আগে ওয়াসার এক ড্রাইভারের বহুতল ভবনের ছবি দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ পত্রিকা সহ আরও বেশ কয়েকটি পত্রিকায় এসেছিল।

গ্যাসের ক্ষেত্রে বলতে গেলে নতুন সংযোগ বন্ধ।চট্টগ্রামে আবাসিক ও শিল্প কারখানায় পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ নেই। একটি সংঘবদ্ধ চক্র মোটা টাকার বিনিময়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়ে আবাসিক এলাকায় গ্যাস সংকট দ্বিগুন করে দিয়েছে।মাঝে মাঝে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও পরবর্তীতে আবারো দ্রুত পুনঃসংযোগ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০/২৫ বছরের পুরনো গ্যাস লাইনের সংস্কার করা জরুরী হলেও কর্তৃপক্ষ তাতে হাত দেয়া জরুরী মনে করছেনা। অনেক জায়গায় লাইনে ময়লা এসে জ্যাম ধরে গেছে। কোথাও রেগুলেটর নষ্ট হয়ে গেছে। মেরামত ও সংস্কারহীন ভাবে থেমে থেমে চলছে গ্যাস। গ্রাহকেরা পর্যাপ্ত গ্যাস না পেলেও বর্ধিত গ্যাস বিল কিন্তু বরাবর পরিশোধ করে আসছে দীর্ঘদিন যাবৎ।

বিদ্যুতের কথায় আসা যাক, সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী নতুন নতুন গ্রিডে বিদ্যুৎ যোগ হয়েছে। কিন্তু ভষ্যের সাথে অবস্থার কোন মিল নেই। প্রতিদিন সকালে বিদ্যুৎ চলে যায়। সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ যায়। বিদ্যুৎ আসে গভীর রাতে। সারাদিন বিদ্যুৎ এর আনাগোনায় শৈশবে পড়া সেই ফুয়াদের গল্প বলার সেই গল্পটার কথা মনে পড়ে যায়। ফুড়ুৎ – ফুড়ুৎ।রাজা জিজ্ঞেস করলেন-ফুড়ুৎ আর কতক্ষন চলিবে ? ফুয়াদের উত্তর-চড়ুই-পাখি যতক্ষন যাওয়া আসা করিতে থাকিবে ফুড়ুৎ ও ততক্ষন চলিবে’। অথবা এভাবেও বলা যায়-আগে মাঝে মাঝে লোডশেডিং হতো, এখন মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ আসে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলিতে বিদ্যুতের তার থাকে মাটির নীচে ফলে অনাকাংখিত তার ছেঁড়ার দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ঝড়, বৃষ্টি জলোচ্ছ্বাসে আমাদের মত বিদ্যুৎ বন্ধ করতে হয়না।তাদের জনবল সংকটের কোন অভিযোগ নেই। প্রত্যেকটা লোক স্ব-স্ব অবস্থান থেকে নিজ দায়িত্ত্ব অত্যান্ত সুচারু রুপে পালন করে থাকে।বৈদ্যুতিক তারে কাপড় শুকানো কিংবা কাক বসার কোন সুযোগ নেই। ওভার লোডের দরুন ঘন ঘন ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ হওয়ার সুযোগ নেই।বিদ্যুৎ এর উন্নতি হলেও সেবার মান বাড়েনি। বাড়েনি দক্ষ জনবল। একটি মিটার সংযোগ দিতে গেলে পাঁচশ থেকে হাজার টাকা ঘুষ দাবি করা হয়। ট্রান্সফরমারের ত্রুটি সারাতে এলে মোটা অংকের টাকা দিতে হয় সংশ্লিষ্ট টিমকে। মোদ্দা কথা বিনা পয়সায় পিডিবি’র লম্বা সিঁড়ি টাও খাড়া হয়না। প্রতিটি সেক্টরে কথিত সেবার চিত্র দেখলে আফসোস করা ছাড়া আর কিছুই থাকেনা। একথা সত্য যে প্রতিটি সেবা খাত গুলি যদি সততার সাথে নিষ্ঠার সাথে সেবা প্রদান করে থাকে তাদের দায়িত্ত্বকে ইবাদত মনে করে তবে উন্নয়নের সুবাতাস মানুষের হৃদয়ে ঠাণ্ডা পৌঁছাবে।

____________________________ লেখকঃ সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply