২৯ মার্চ ২০২৪ / ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ / দুপুর ১:৪৫/ শুক্রবার
মার্চ ২৯, ২০২৪ ১:৪৫ অপরাহ্ণ

শ্রমবাজারে গতি আনতে হবে

     

মাহমুদুল হক আনসারী
বাংলাদেশের কর্মক্ষম শ্রমিকদের নানাভাবে কর্মসংস্থান আন্তর্জাতিকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। জনসংখ্যায় জনবহুল কর্মক্ষম মানুষের দেশ বাংলাদেশ। প্রায় আটারো কোটি নর-নারীর বাংলাদেশ। এখানে প্রতিবছর শিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত, কারিগরী শিক্ষায়, উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করে বেকারের তালিকায় সংযুক্ত হচ্ছে কোটি কোটি তরুণ তরুণী। সে পরিমাণ সরকারি বেসরকারি কর্মসংস্থান তৈরী হচ্ছে না। সামান্য কর্মখালি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি যখন প্রচার করা হয় তখন একটি পদের জন্য হাজার হাজার চাকরী প্রত্যাশীদের আবেদন জমা হয়। এভাবে সরকারি বেসরকারি কিছু খালি পদে স্বল্প সংখ্যক শিক্ষিত তরুণ তরুণী নিয়োগ লাভ করে। প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষিত যুবক বেকার হয়ে পড়ছে। তাদের মধ্যে অর্ধ শিক্ষিত, কারিগরী শিক্ষায় শিক্ষিত বেকারও রয়েছে। অনেকেই দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান না পাওয়াতে সহায় সম্বল জোগাড় করে বিদেশের মাটিতে গিয়ে হলেও একটা কর্মসংস্থান আশা করে। কারণ জীবনের বিরাট একটি সময় শিক্ষা অর্জনের জন্য ব্যায় করে মূল্যবান বয়স পার করেছে। শিক্ষা অর্জনের সাথে সাথে বিশাল একটি বয়সও তার জীবন থেকে ঝরে গেছে। তার জীবন, পরিবার পরিজনের জন্য তাকে তো কিছু না কিছু করতেই হবে। কিন্তু কী করবে তার কোনো কূল কিনারা দেশে হয় না। তাই অজগাঁ গ্রামের শিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত, কারিগরী শিক্ষায় গড়ে উঠা এসব মানুষ নিজ ও পরিবারের ভরণ পোষণের জন্য দেশের বাইরে গিয়ে কর্মসংস্থান খুঁজে। আর সেটা রিক্রুর্টিং এজেন্সি ছাড়া হয় না। একসময় বাংলাদেশে রিক্রুর্টিং এজেন্সির ব্যবসা জমজমাট ছিল। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ফলে বেশি আয় হয় রেমিটেন্স। সে ধারা অব্যাহত ছিল। হঠাৎ করে আন্তর্জাতিক দেশে শ্রমবাজার ছোট হয়ে আসলে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ক্রমশ সীমিত হয়ে আসছে। মাত্র কয়েক বছর আগেও এ ব্যবসা ছিল রমরমা। সবগুলো এজেন্সিতে বিদেশ গমনেচ্ছুদের সরগরম দেখা যেত। সবসময় ভিড় লেগে থাকত। তা সামলাতে তাদের হিমশিম খেতে হতো। আর এখন নামমাত্র ভাবে রিক্রুর্টিং এজেন্সির কার্য্ক্রম চলছে। এসব এজেন্সিতে সারাদিন মিলে দুয়েকজন কর্মীও চোখে পড়ে না। কেন এ দুরবস্থা? কারণ হিসেবে অনেকগুলো এজেন্সি মালিক অভিযোগ করে বলছেন, নতুন কোনো শ্রমবাজার উন্মোচিত হচ্ছে না। সৌদি আরবের মতো বাংলাদেশের জনশক্তির বিশাল শ্রমবাজার আগের মতো আর নেই। এখানে পবিত্র মক্কা মদিনা হওয়ার কারণে হজ্জ্ব, ওমরা যাত্রী ছাড়া কোনো যাত্রী তেমন দেখা যায় না। মালয়শিয়ার শ্রমবাজারেও অচল অবস্থা দূর হয় নি। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাজারেও দূর্দিন। জনশক্তি রপ্তানীর জন্য সুসময় ছিল ২০১৭ সাল। এরপর থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী প্রধান এ খাতটিতে ধস নামা শুরু হয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০১৭ সালে প্রতিমাসে বিদেশে কর্মী গেছে ৮৪ হাজার। সেটা গতবছরে ২০১৮তে নেমে আসে ৬১ হাজার ১ শত ৪৬ জনে। বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর(বিএমইটি) সদ্য প্রকাশিত পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম জানুয়ারী মাসে বিদেশে কর্মী হয়ে গেছে ৫৯ হাজার ৩৭ জন মাত্র। ২০১৮ সালের জানুয়ারী মাসের এ সংখ্যা ছিল ৮১ হাজার ৮ শত ৪৬ জন। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ওই সময়ে যারা গেছে তাদের ৫১ শতাংশ হলো সৌদি আরবে। আর সেখানে এখন নেমে এসেছে ৩ হাজার ১ শত ৫১ জনে। গতবছরের জানুয়ারীতে সেখানে কর্মী গিয়েছিল ৩৮ হাজার ৯ শত ৫৪ জন। ওমানে গিয়েছিল ৮ হাজার ৩ শত ২৭ জন। কাতারে গিয়েছিল ৭ হাজার ৮ শত ৭১ জন। রিক্রুর্টিং এজেন্সি কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে বৈদেশিক কর্মসংস্থানে চরমভাবে অচল অবস্থা বিরাজ করছে। বিগত সরকার দফায় দফায় সফর করেও কর্মসংস্থানের সুফল আনতে সক্ষম হয় নি। ২৬ টি দেশকে সম্ভাবনাময় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এখনও সম্ভাবনার তালিকায় সেগুলো আছে। অপরদিকে কতিপয় দেশে রপ্তানী বাজার সীমিত হয়ে পড়েছে। অনেকগুলো দেশের শ্রমবাজার একেবারে বন্ধ হয়ে পড়েছে। বাহরাইন, লিবিয়া, সুদান, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রিটেন, ইতালী এবং মিশরে নতুন বছরের প্রথম মাসে কোনো কর্মী যায় নি। সৌদি আরবের কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজারে নানা নিয়ম অনিয়ম থাকায় সেখানে কর্মীদের যাতায়াতে আগ্রহ সীমিত হয়ে আসছে। ফ্রি ভিসায় গিয়ে প্রচুর টাকা দিয়ে ভিসা কিনে কাঙ্খিত চাকরী সেখানে জোটে না। তাছাড়া সে দেশের সরকারের নানামুখী আইনের বেড়াজালে জটিলতায় পড়তে হয় শ্রম কর্মীদের। অনেক প্রত্যাশা করে নারী শ্রমিক সে দেশে যাওয়ার একটা আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু নানাবিধ সমস্যায় পড়ে নারী শ্রমিক যাওয়াও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন থেকে যারা অবৈধভাবে সেখানে বসবাস করে আসছে তাদেরও রাষ্ট্রীয় সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ফলে আগের মতো সৌদিতে কর্মী যাওয়ার প্রবণতা হ্রাস পাচ্ছে। মালয়শিয়ায় বাংলাদেশীদের জন্য ভালো একটি শ্রমবাজার ছিল। কিন্তু সে বাজারও সংকটমুক্ত হচ্ছে না। ১০টি এজেন্সির ১ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সেখানে জনশক্তি রপ্তানী অব্যাহত ছিল। তাদের দুর্নীতি পাওয়ায় মালয়শিয়া সরকার জনশক্তি রপ্তানী বন্ধ করে দেয়। যেখানে গতবছরের জানুয়ারী মাসে ১৪ হাজার ৫ শত ৪৫ জন জনশক্তি গিয়েছিল, সেখানে বর্তমান বছরের প্রথম মাস জানুয়ারীতে গেছেন মাত্র ২১ জন। জনশক্তি রপ্তানী খাতে চলমান বিপর্য্য় পরিস্থিতি অবশ্যই কাটিয়ে উঠার জোর চেষ্টা চালাতে হবে। বিশ্লেষকদের অভিমত, সরকারের ভুল নীতি, কূটনৈতিক ব্যার্থতা এর জন্য দায়ী। রিক্রুর্টিং এজেন্সি সরকার সম্মিলিতভাবে এ অচলাবস্থাকে দূর করতে কঠোর চেষ্টা চালাতে হবে। তবেই আশা করা যায়, বৈদেশিক কর্মসংস্থানের আশাব্যাঞ্জক সুফল। জাতীয়ভাবে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে এ খাতকে গুরুত্ব দিয়ে সরকারের অন্যান্য সেক্টরের সফলতার সাথে এ খাতের সফলতা প্রত্যাশা করছি।

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply