২০ এপ্রিল ২০২৪ / ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / সকাল ৯:১৯/ শনিবার
এপ্রিল ২০, ২০২৪ ৯:১৯ পূর্বাহ্ণ

স্মার্টফোন দিয়ে সন্তানের উপকার না, ক্ষতি করছেন

     

সন্তানের হাতে স্মার্টফোন তুলে দেওয়ার সর্বনিম্ন বয়স কত হওয়া উচিত? অংক করে এর কোনো সঠিক উত্তর পাওয়া সম্ভব নয়। অভিভাবকরা বরং নিজেকেই প্রশ্ন করতে পারেন—‘একজন শিশু বা কিশোর বয়সের বাচ্চার জন্য স্মার্টফোন কতটা প্রয়োজনীয়?’ অভিভাবক, আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য একটি ফোন দরকার হতেই পারে। সেটার জন্য সাধারণ একটা ফোনই যথেষ্ট। স্মার্ট ফোন কি খুব জরুরি? নিশ্চয়ই নয়।

অথচ অনেকে মোবাইল ফোনকে এখন কথা কিংবা বার্তা প্রদানের যন্ত্র হিসেবে দেখছেন না। দেখছেন ‘স্ট্যাটাস সিম্বল’ হিসেবে। তাদের ধারণা, হাতে যত দামী ফোন, লোকে সম্মান দেয় তত বেশি। তাই ‘সম্মান সচেতন’ অভিভাবকরা তাদের শিশু-কিশোর সন্তানদের হাতেও তুলে দিচ্ছেন দামি স্মার্ট ফোন। আর বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তিতে ‘অভিজ্ঞ’ করে তোলার মানদণ্ড যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশেষ করে ফেসবুকে একটা একাউন্ট থাকা। তাই স্মার্টফোন হাতে পেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার এই তলাবিহীন জগতে প্রবেশ করে তার নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ছে এসব শিশু-কিশোররা। প্রাথমিকে পড়ুয়া একটা ছাত্র কিংবা ছাত্রীও ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট থাকাটাকে স্মার্টনেস হিসেবে গণ্য করছে। বুঁদ হয়ে যাচ্ছে স্ট্যাটাস, ছবি, সেলফি পোস্ট, লাইক কিংবা কমেন্টের নেশায়। পড়ার টেবিলের চেয়ে ফোনের পর্দাই তার কাছে বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। তাই তথ্য প্রযুক্তির সুফলের চাইতে কুফলটাই গ্রাস করছে আমাদের সন্তানদের।

সন্দেহ নেই যে, মোবাইল ফোন আমাদের জীবনকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। কিন্তু পাশাপাশি এটি আমাদের জন্য বয়ে নিয়ে এসেছে নানাবিধ সমস্যাও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মা-বাবা যতই ধনাঢ্য বা অভিজাত পরিবারের মানুষ হোন না কেন, তাদের শিশু-কিশোরদের হাতে স্মার্ট ফোন তুলে দেওয়াটা একবারেই অযৌক্তিক। শিশুকে বাস্তব ও ভার্চুয়াল জগতের মধ্যে সীমানা নির্ধারণ করে দেয়ার দায়িত্ব অভিভাবকদেরই। গবেষকরা বলছেন, এখনকার শিশুরা নানা ধরনের গেমস ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছে যে, একবার হাতে তুলে দেয়ার পর সেটি নিয়ে নিলে তারা কান্নাকাটি জুড়ে দেয় কিংবা নানা অস্বাভাবিক আচরণ করে। এমনিক নানা অযাচিত কাজকর্মের হুমকিও দিয়ে বসে। তারা এক হাতে ফোনের পর্দায় হাত বুলাচ্ছে, অন্য হাতে খাবার খাচ্ছে। ভার্চুয়াল জগতে এমনই বুঁদ হয়ে থাকে যে, অন্য কোনো দিকে খেয়াল করে না। এ ধরনের শিশুদের আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি থেকে যায়। তারা সাধারণত কারও সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলে না, যার ফলে পারিবারিক বন্ধনে ও পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কে পরিবর্তন আসছে। স্মার্ট ফোন আসক্তি বাড়তে থাকলে পড়াশোনায় খারাপ করতে শুরু করে কিশোর ও তরুণরা। তখন তারা গুটিয়ে যায়, পা বাড়ায় বিপথে। মনস্তত্ত্ববিদরা বলছেন, বড় সামাজিক অবক্ষয় নেমে আসার আগে অভিভাবকদের সচেতন হবার এখনই সময়।

শিশু বিষয়ক চিকিত্সকরা বলছেন, শিশুদের কোনোভাবেই প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে দেওয়া উচিত নয়। তাদের সামনে প্রযুক্তিপণ্য উন্মোচন করা ঠিক নয়। কারণ এ সময় তাদের নিজেদের মেধা খাটিয়ে নতুন নতুন জিনিস শেখার বয়স। নতুনকে জানার বয়স।

কথাসাহিত্যিক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মোহিত কামাল বলেন, স্মার্ট ফোনে অনেক মজার মজার জিনিস থাকে। এসব মজার জিনিস মস্তিষ্ককে দখল করে। মানুষের ব্রেইনে মোটিভেশনাল ফোর্স থাকে। যা একটি মানুষকে পরিচালিত করে। এই মোটিভেশনাল ফোর্স হচ্ছে ‘প্রেষণা’। ‘প্রেষণা’ হচ্ছে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক তিন উপাদান- উত্সাহ, আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা। এই চাহিদাগুলোই মানুষকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যায়। সেই চাহিদার কারণেই শিশু-কিশোররা কেউ কেউ শিক্ষক, কেউ ডাক্তার, কেউ খেলোয়াড়, কেউ পাইলট হতে চায়। স্মার্ট ফোন আসক্তি যখন জন্মায় তখন মোটিভেশনাল ফোর্স স্মার্ট ফোন দখল করে নেয়। মনোযোগ ঘুরে যায় ফোনের দিকে। তখন সেই শিশু-কিশোরের সামাজিকতা, খেলাধুলা, পড়াশোনা, গল্পের বই পড়া এসব কোনোকিছুতেই আর মনোযোগ থাকে না। লক্ষচ্যুত হয়ে পড়ে। আর তরুণরা অনৈতিকতার দিকে ঝোঁকে। নিজেকে বিকশিত করার বদলে গুটিয়ে যায়। অনেকে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। টিনএজাররা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও পর্ন সাইটে ঢোকে। আসক্ত হয়ে যায়। আর তখনই তারা পড়াশোনায় খারাপ করতে শুরু করে। যখন পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ করে তখন মা-বাবার টনক নড়ে।

মোহিত কামাল আরো বলেন, বিশ্ব হয়ে গেছে প্রযুক্তির গ্রাম। কাউকেই ডিজিটাল দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা যাবে না। কিন্তু নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। যখনই তরুণরা ফোন ব্যবহার করে রাত জাগা শুরু করে, রাতভর ফোনে কথা বলে, গান শোনে- তখনই বিপত্তি ঘটে।। কেননা, রাত হচ্ছে ঘুমানোর জন্য। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু তরুণরা স্মার্ট ফোনে রাত জেগে সময় কাটায়, আর দিনের বেলা ঝিমায়। ফলে তাদের ব্রেইন অপ্রাকৃতিক গতি পায়। যা তার সামগ্রিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে। আর সে কারণেই অভিভাবকদের নজর রাখতে হবে তার সন্তানদের প্রতি। সন্তানদের রাতের বেলা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেওয়া যাবে না। তারা সন্ধ্যার পর থেকে স্মার্ট ফোন ব্যবহার করবে না। মা-বাবাকে এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, খেলার মাঠ না থাকায় শিশুরা বাসায় অনেকটা সময় একলা কাটায়। সেই ফাঁকা সময়ে গল্পের বই বা অন্য কোনো খেলাধুলার চাইতে মোবাইল ফোনে সময় কাটাতে পছন্দ করে তারা। একটা সময় এটাই নেশায় পরিণত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রযুক্তির সংস্পর্শে থাকা শিক্ষণীয় বিষয় কিন্তু তা যখন বিনোদন ও সময় কাটানোর ডিভাইসে পরিণত হয়- তখন তা থেকে দূরে থাকতে হবে। সুপার ফার্স্ট গেমস ও কার্টুন দেখতে থাকলে ছোট্ট শিশুদের মুখে কথা ফুটতে দেরি হয়। এমনকি প্রযুক্তি-আসক্তি শিশুদের মোটা হয়ে যাওয়া ও ঘুম কম হওয়ার একটি বড় কারণ।

নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ ডা. প্রাণ গোলাপ দত্ত বলেন, মোবাইল ফোন শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। মোবাইল ফোন থেকে নির্গত রশ্মি শিশুদের দৃষ্টিশক্তির ভীষণ ক্ষতি করে। যেসব শিশু দৈনিক পাঁচ-ছয় ঘণ্টা মোবাইল ফোনে ভিডিও গেম খেলে, খুব অল্প বয়সে তারা চোখের সমস্যায় পড়বে। অন্যদিকে, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ এ এসএম মাহমুদুজ্জামান বলেন, আজকের শিশুরা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ঘেরা এক পরিবেশের মধ্যে বড় হচ্ছে, ফোন থেকে যে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি নির্গত হয় তা তাদের জন্য ভয়ঙ্কর পরিণতি নিয়ে আসতে পারে।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply