২৪ এপ্রিল ২০২৪ / ১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / বিকাল ৫:২০/ বুধবার
এপ্রিল ২৪, ২০২৪ ৫:২০ অপরাহ্ণ

কর্মযোগে ভগবদগীতা – অর্চণা রাণী আচার্য

     

কর্ম মানে কাজ। যোগ মানে কৌশল। যোগঃ কর্মসু কৌশলম্ (গীঃ ২/৫)। গীতার মতে, কাজ করার Technique- ই হচ্ছে যোগ। আসলে কী সেই কৌশল? মা ফলেষু কদাচন। (গীঃ ২/৪৭) কাজ করেও কাজের ফল লাভের জন্য কোন আকাক্সক্ষা না করার নামই হচ্ছে “কৌশল”।
দ্বাপর যুগের শেষার্ধে জ্ঞানবাদী ও কর্মবাদীদের মধ্যে দারুণ বিরোধ বেঁধেছিল জ্ঞান ও কর্ম নিয়ে। এই বিরোধের মূল সূত্রপাত ছিল বেদ থেকে। প্রত্যেক বেদে আছে দু’টি কাণ্ড। (১) জ্ঞানকাণ্ড, (২) কর্মকাণ্ড। কর্মকাণ্ডে আবার দুটি ভাগ: সংহিতা আর ব্রাহ্মণ। আবার জ্ঞানকাণ্ডেও দুটি ভাগ: উপনিষদ ও আরণ্যক। ভারতীয় ষড়দর্শনের পূর্ব মীমাংসাভাগ কর্মমার্গী। এতদ্ব্যতীত ষড়দর্শনের সর্বাংশই জ্ঞানমার্গী।
অবশেষে, দেখা গেল বেদের কর্মকাণ্ডের অনুসারীরা স্বর্গাদি ফল লাভ করার জন্য যজ্ঞাদি করাই ধর্ম। ধর্মের সবকিছু বলে প্রতিষ্ঠা করে। এই যজ্ঞ করলে এই ফল হয় ইত্যাদি। সুতরাং যজ্ঞ কর আর ফল ভোগ কর। এর বাইরে আর ঈশ্বর কী, কী ব্রহ্মা, কী মোক্ত, কী মুক্তি এই সব নিয়ে কথা নেই। একই সময়ে জ্ঞানীবাদীরা বলতেন, “কর্ম বন্ধনের হেতু”। অতএব কর্মত্যাগই একমাত্র কর্তব্য।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার গীতার কর্ম এবং জ্ঞান এই দুই দার্শনিক ভাবের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন রচনা করে এক চমৎকার সমন্বয় সৃষ্টি করলেন। ফলে জ্ঞানমার্গী ও কর্মমার্গীর মধ্যে ঘটল এক “মহামিলন” আর ভারতীয় দর্শনে সংযোজিত হল এক নতুন দার্শনিক তত্ত্ব।
এই সমন্বয়ী দার্শনিক তত্ত্বই ভগবদগীতায় কর্মযোগ। গীতোক্ত কর্মযোগ একটি তিনবাহু বিশিষ্ট ত্রিভুজের মত। যেমন:
(১) এক বাহুতে কর্মফল ত্যাগ।
(২) আরেক বাহুতে কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ এবং
(৩) অন্য বাহুতে ঈশ্বরে কর্ম সমর্পণ।
এই তিন বাহুর ভিতর থেকে কর্ম করলেই কর্ম হবে যথার্থ গীতোক্ত কর্মযোগ। এখানে কর্ম ফলকাক্সক্ষা ত্যাগই মোক্ত। কর্ম ফলাকাক্সক্ষা ত্যাগই হলেই কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ হবে। এই দুটো ত্যাগ হলে শুধু কর্ম কেন, জীবনই হবে ঈশ্বরে সমর্পিত।
গীতার প্রথম ছয় অধ্যায় নিয়ে কর্মকাণ্ড। যদিও কেবলমাত্র তৃতীয় অধ্যায়ের নাম দেয়া হয়েছে কর্মযোগ। বাকী পাঁচটি অধ্যায়ের আলাদা আলাদা নাম। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পাঁচটি অধ্যায়ের প্রত্যেকটির নিজস্ব বিষয়বস্তুর ভিতরে কর্মযোগের মূলতত্ত্ব অনুপ্রবিষ্ট। এ যেন কৃষ্ণবর্ণ, শ্বেতবর্ণ ও পিঙ্গল বর্ণের শালগ্রাম। কিন্তু প্রত্যেকটিতেই ঘৃত মাখানো।
প্রথম অধ্যায়ে অর্জুন কুরুক্ষেত্র রণাঙ্গণে বিপুল সৈন্য সম্ভার দর্শন করে বলে উঠলেন তিনি যুদ্ধ করবে না। ইহা তো কর্মত্যাগের সিদ্ধান্ত। এই কর্মত্যাগের সিদ্ধান্তই পটভূমি সৃষ্টি করে দিল কর্মফল ত্যাগের অর্থাৎ গীতোক্ত “কর্মযোগের”।
দ্বিতীয় অধ্যায় হচ্ছে সাংখ্যযোগ। সাংখ্য শব্দের অর্থ তত্ত্বজ্ঞান। তত্ত্বজ্ঞানই জ্ঞানমার্গ। একে আবার সন্ন্যাস বা নিবৃত্তি মার্গও বলা হয়। অর্জুনকে আত্মার অবিনশ্বরতা বিষয়ক তত্ত্ব বলতে বলতে দ্বিতীয় অধ্যায়ে ৩৯নং শ্লোকে বলেছেন: “হে পার্থ, তোমাকে এতক্ষণ সাংখ্য বিষয়ক জ্ঞানের কথা বললাম। এখন কর্মযোগের কথা বলব। বাহু বলে তুমি কর্মবন্ধন ত্যাগ করতে পারবে।” ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই বাক্যে মনে হয় যে, শুধু তত্ত্বজ্ঞানে পূর্ণতা আসে না। এর জন্য প্রয়োজন নিষ্কাম কর্ম, যা তার কর্মযোগের মূলকথা।
তৃতীয় অধ্যায়ের নামই কর্মযোগ। এই অধ্যায়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে কর্মের বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্বসমূহ নিয়ে। কারণ কর্ম মানুষের প্রকৃতিজাত ধর্ম। কর্ম অবশ্যই করতে হবে। কর্ম ছাড়া কেউ থাকতে পারে না। হাতে কর্ম না করলেও মনের ভেতর যে বাজার বসে যায় তা কর্ম নয় কি? সুতরাং ফলাকাক্সক্ষা বর্জন করে কর্ম করাই শ্রেয়।
চতুর্থ অধ্যায় হচ্ছে জ্ঞানযোগ। জ্ঞানীর লক্ষণ বলতে এখানে নিষ্কাম কর্মের কথা বলা হয়েছে। জ্ঞানাগ্নিতে দগ্ধ হলেই জ্ঞানীর কর্মফল স্পৃহা বিদূরিত হয়। (৫/১৯)
পঞ্চম অধ্যায় ১৪নং শ্লোকে শ্রী ভগবান বলেছেন, তাঁর নিজের কর্মফলে যেমন স্পৃহা নেই তেমনি কর্মসকল তাকে লিপ্ত করতে পারে না। যদিও তিনি অহরহ কর্ম করেন। সন্ন্যাস যোগই হচ্ছে পঞ্চমঅধ্যায়। ভগবতগীতার মতে, কর্মত্যাগে সন্ন্যাস নয়। কর্মফল ত্যাগই যথার্থ সন্ন্যাস হয়। কর্ম করেও সন্ন্যাসী হওয়া যায়। যদি কর্ম হয়। ফলকাক্সক্ষাবর্জিত।
ষষ্ঠ অধ্যায় হচ্ছে অভ্যাস বা ধ্যান যোগ। মনকে অভ্যাস বা ধ্যান দ্বারা নিরুক্ত করার বিধান আছে এই অধ্যায়ে। বাস্তবিকপক্ষে, ধ্যান বা অভ্যাসের পূর্বশর্ত হলো কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ, সর্বকর্ম, ঈশ্বরে সমর্পণ এবং কর্মফলাকাক্সক্ষা বর্জন।
গীতার ১ম ৬ষ্ঠ পর্যন্ত অধ্যায়গুলির বিষয়বস্তুর ভিন্নতা থাকলেও প্রত্যেকটির ভিত্তিই কর্মযোগ। তাই এই প্রথম ছয় অধ্যায়কে কর্মকাণ্ড বলা তাৎপর্যপূর্ণ। সমগ্র গীতাই এই নিষ্কাম কর্মতত্ত্বের উপর দণ্ডায়মান। ফলে নিষ্কাম কর্ম সকলেরই অনুকরণীয়। জ্ঞানী, ধ্যানী, ভক্ত, গৃহী ও সন্ন্যাসী সকলেরই নিষ্কাম কর্ম করা কর্তব্য। নিষ্কাম কর্ম বন্ধনের মুক্তির হেতু। পক্ষান্তরে, সকাম কর্ম বন্ধনের কারণ। নিষ্কাম কর্ম সাধনের জন্য জ্ঞান অপরিহার্য। একমাত্র জ্ঞানীই নিষ্কাম কর্ম করতে পারেন। গীতা তাই বলেছেন, “আমাকে অনুসরণ কর, যুদ্ধও কর। যুদ্ধ কর জগতের হিতার্থে। যুদ্ধ জগৎ হিতার্থে তখনই হয় যখন যুদ্ধ হয় ফলাকাক্সক্ষাবর্জিত।
তাই ফলাকাক্সক্ষাবর্জিত জগৎ হিতার্থে কৃতকর্ম জগৎপতিরই কর্ম। নিষ্কাম কর্ম মানুষকে স্বার্থবুদ্ধির ঊর্ধ্বে তোলে তার হৃদয়ে আত্মজ্যোতি প্রজ্বলিত করে। নিরন্তর বহমানিত হউক প্রতিটি মানব জীবনে গীতার শান্তিময় অমৃতবাণী।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply