২৯ মার্চ ২০২৪ / ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ / সন্ধ্যা ৬:৩১/ শুক্রবার
মার্চ ২৯, ২০২৪ ৬:৩১ অপরাহ্ণ

“সাগরে কাঁচা মাছ খেয়ে ৪৯ দিন বেঁচেছিলাম”

     

সাগরে টানা ৪৯ দিন ধরে ভেসে থাকার পর উদ্ধার হওয়া ইন্দোনেশিয়ার কিশোর বলেছেন, তার জীবনে এরকম ঘটনা এর আগেও ঘটেছে।

মাছ ধরার জন্যে তৈরি একটি ভেলায় দিনের পর দিন ভেসেছিলেন ১৮ বছর বয়সী আলদি নোভেল আদিলাং। সমুদ্রের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে তিনি চলে গিয়েছিলেন বহু দূর।

উদ্ধার হওয়ার কয়েকদিন পর তিনি বলেছেন, এর আগেও তিনি একবার কিম্বা দু’বার নয়, তিন তিনবার এরকম মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন। এবার তিনি আর সমুদ্রে যাবেন না বলে ওয়াদা করেছেন।

অলৌকিকভাবে তার বেঁচে যাওয়ার সর্বশেষ এই গল্প সবচেয়ে দীর্ঘতম। আগের দু’বার এতো দীর্ঘ সময় ধরে তাকে সাগরে ভেসে থাকতে হয়নি। আর একরাণেই এই ঘটনা সারা বিশ্বের দৃষ্টি কেড়েছে।

মাছ ধরার জন্যে তৈরি কাঠের একটি ভেলায় ভেসে বেড়িয়েছেন তিনি। ভেলায় ভেসে ভেসে সমুদ্র থেকে মাছ ধরার এই পদ্ধতিকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় রমপং।

ভেলার উপরে থাকে একটি কুড়ে ঘর। সাগরের মাঝখানে ভেসে বেড়ায় ভেলাটি। এবং দড়ি দিয়ে এটি নোঙর করা থাকে সমুদ্রের তলদেশে।

গত জুলাই মাসের ১৪ তারিখে তিনি নোঙর করেছিলেন ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপ থেকে ৭৭ মাইল দূরে। কিন্তু যে দড়িটি তার ভেলাকে সমুদ্রের তলদেশের সাথে আটকে রেখেছিল ঝড়ের কবলে পড়ে সেটি হঠাৎ করেই ছিন্ন হয়ে যায়। তারপর সে ভেসে চলে যায় সমুদ্রের আরো গভীরে।

“আমার এক বন্ধুর রমপং-এর দড়ির সাথে প্যাঁচ লেগে আমার ভেলাটির দড়ি হঠাৎ করে ছিঁড়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো সে তখন ঘুমিয়ে ছিল। ফলে আমি যে ভেসে দূরে চলে গেছি সেটা সে তখন বুঝতে পারেনি,” বলেন মি. আদিলাং।

উদ্ধার হওয়ার পর তিনি এখন আছেন উত্তর সুলাওয়েসি দ্বীপের মানাদো শহরে নিজেদের বাড়িতে, তার বাবা মায়ের সাথে।

তিনি জানান, ভেসে যাওয়ার পর প্রথম কয়েকদিন তার সাথে যেসব খাবার দাবার ছিল সেসব খেয়ে তিনি বেঁচেছিলেন। কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যেই তার সাথে থাকা সব খাবার শেষ হয়ে যায় বলে তিনি জানান।

“আমার সাথে ছিল ভাত, খাবার পানি, মশলা, রান্নার গ্যাস এবং রান্না-বান্নার জন্যে প্রয়োজনীয় আরো কিছু জিনিস। কিন্তু কয়েকদিন পর সবকিছু ফুরিয়ে গেল। বেঁচে থাকার জন্যে তখন আমি মাছ ধরতে শুরু করলাম। যেসব কাঠ দিয়ে রমপং-এর কুড়েঘরটি বানানো হয়েছিল সেগুলো দিয়ে আগুন জ্বালাতাম। ওই আগুনে মাছ পুড়িয়ে খেয়ে বেঁচেছিলাম আমি। কাঁচা মাছও খেয়েছি,” বলেন তিনি।

কিন্তু তার জন্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল খাবার পানি। সেটা তিনি কোথায় পেয়েছেন?

এজন্যে তিনি একটি কৌশল বের করে নিয়েছিলেন। তিনি জানান, প্রথমে তিনি তার জামাকাপড় সমুদ্রের পানিতে ভিজিয়ে নিতেন। তারপর ওই কাপড় থেকে পানি বের করে সেই পানি খেতেন তিনি। অর্থাৎ নিজের জামাকাপড়কে তিনি ফিল্টার বানিয়েছিলেন সমুদ্রের পানি থেকে লবন আলাদা করতে।

তিনি বলেছেন, এই পদ্ধতিতে তিনি সমুদ্রের পানির লবনাক্ততা অনেকটাই কমিয়ে আনতে পেরেছিলেন।

“বাঁচাও, বাঁচাও”

সমুদ্রের বুকে তিনি ভেসেছিলেন টানা ৪৯ দিন। তিনি জানান, এই দেড় মাসে তার পাশ দিয়ে গেছে দশটির মতো জাহাজ। কিন্তু তারা কেউই তাকে দেখতে পায়নি।

এই কিশোর তরুণ জানান, তিনি যখন একা একা সমুদ্রে ভাসতেন তখন খৃস্টান ধর্মের গান গাইতেন, তার সাথে থাকা বাইবেল থেকে পাঠ করতেন এবং অনবরত প্রার্থনা করতেন। ঈশ্বরের কাছে তিনি চাইতেন তার বাবা মায়ের সাথে যেন আরো একবার দেখা হয়।

ভাসতে ভাসতে অনিশ্চয়তায় ডুবে গিয়ে একবার খুব ভেঙে পড়েছিলেন মি.আদিলাং। তিনি ভেবেছিলেন সমুদ্রে ডুবে গিয়ে আত্মহত্যা করার কথাও।

তিনি জানান, ৩১শে অগাস্ট তিনি তার ভেলা থেকে একটু দূরে কয়লাবাহী একটি জাহাজ দেখতে পান।

“সে সময় আমি বাঁচাও বাঁচাও (হেল্প হেল্প) বলে চিৎকার করেছিলাম। একমাত্র এটাই (ইংরেজি) আমার জানা ছিল,” বলেন মি. আদিলাং। তিনি তখন ভাসতে ভাসতে ইন্দোনেশিয়া থেকে বহু দূরে গুয়ামের জলসীমায় চেলে গেছেন। কিন্তু এসম্পর্কে তার কোন ধারণা ছিল না।

পানামার পতাকাবাহী ওই জাহাজটি তখন তাকে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে। প্রথমে তাকে খাওয়ার জন্যে কিছু পানি দেওয়া হয় আর কিছু জামা কাপড় দেওয়া হয় পরার জন্যে।

ওই জাহাজটি তখন জাপানের দিকে যাচ্ছিল। তীরে গিয়ে পৌঁছাতে আরো এক সপ্তাহ লাগে ওই জাহাজের।

মি. আদিলাং জাপানে গিয়ে পৌঁছান ৬ই সেপ্টেম্বর। তারও দুদিন পর বিমানে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ইন্দোনেশিয়ায়। সেখানে তার পরিবারের সাথে মিলিত হন তিনি।

“আর কখনো যাবো না”

মি.আদিলাং জানিয়েছেন এর আগেও তার আরো দু’বার এরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিন্তু এতো দীর্ঘদিন তাকে সমুদ্রে ভেসে থাকতে হয়নি।

“প্রথমবার ছিল এক সপ্তাহের মতো। ভেলার মালিকই সেবার আমাকে উদ্ধার করেছিলেন। আর দ্বিতীয়বার, আমি সমুদ্রে হারিয়ে গিয়েছিলাম দুদিনের জন্যে। সেবারও ভেলার মালিক আমাকে বাঁচিয়েছিলেন।”

তিনি বলেন, রমপঙ-এ আধুনিক কোন যন্ত্রপাতি নেই যা দিয়ে এর গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। দিক নির্ণয়ের জন্যে তার কাছে কোন কম্পাসও ছিল না। তার কাজ হলো রমপং এর বাতি জ্বালানো। এই আলো দেখেই মাছ আকৃষ্ট হয়।

তিনি যে কোম্পানিতে কাজ করেন, প্রত্যেক সপ্তাহে ওই কোম্পানি থেকে লোকজন গিয়ে ভেলায় থেকে মাছ নিয়ে আসেন। একই সময় তাকে দিয়ে আসা হয় খাবার দাবার, পানি এবং বাতি জ্বালানোর মতো তেলসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় রসদ সামগ্রী।

কোম্পানিটির সাথে তার এক বছরের চুক্তি হয়েছিল। বেতন ছিল মাসে ১৩৪ ডলার।

সবশেষ এই ঘটনার পর মি. আদিলাং বলছেন, তিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন যে মাছ ধরার জন্যে তিনি আর কখনো সমুদ্রে যাবেন না। সূত্র: বিবিসি বাংলা।

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply