২৫ এপ্রিল ২০২৪ / ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / সকাল ১০:১৩/ বৃহস্পতিবার
এপ্রিল ২৫, ২০২৪ ১০:১৩ পূর্বাহ্ণ

বৈশাখ বাঙ্গালীর উৎসব

     

মাহমুদুল হক আনসারী
বাঙ্গালীর প্রাণের উৎসব বর্ষবরণ। ১৪২৩ বাংলা সাল শেষ করে ১৪২৪ বাংলা সালের শুভ আগমণকে সু-স্বাগতম। স্বাগত জানাতে বাঙ্গালী নর-নারী বৃদ্ধ, বণিতা সকলেই এক যোগে বাংলা নববর্ষ পালন করছে। বাংলা নববর্ষকে প্রাণের চেয়ে ভালোবাসে বাঙ্গালী জনগণ। প্রতি ঘরে ঘরে নববর্ষের আনন্দ আর বিদায়ের নানা আয়োজন অনুষ্ঠান চলতে দেখা যায়। মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা, প্রাণের ভাষা মাতৃভাষা, মায়ের ভাষায় কথা বলতে শিখেছি, মাকে ভালোবাসতে শিখেছি। জন্মভূমিকে শ্রদ্ধা ও শান্ত রাখতে শিখেছি। মা, আমাকে মাতৃভূমির ভালোবাসা শিখিয়েছে, দেশকে শান্ত রাখতে বলেছে, মায়ের প্রতি দেশের প্রতি মমত্ববোধ জাগ্রত করতে হবে। বাংলা ভাষার মধ্যে দিয়ে বাঙ্গালী জাতি দুনিয়া জুড়ে সম্মানের আসনে আসীন হয়েছে। তাই বাংলা ভাষা ও নববর্ষ আমার প্রাণের উৎসব। মনের আনন্দ আর আনন্দের দিন আজ, ঘরে ঘরে বর্ষবরণ আনন্দ উদযাপন হচ্ছে। শিশু-কিশোর বৃদ্ধ বণিতা সকলেই আনন্দে মত্তহারা। শহর, গ্রাম, স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সব খানেই চলছে নানা অনুষ্ঠানমালা। সেখানে হচ্ছে বাউলের গান, জারিগান, দেশাত্ববোধক নাটক সংস্কৃতি বাঙ্গলার ঐতিহ্যবাহী পুঁথিগানের আসর কবিতা, নাটক, বাউলের গানে গানে সারাদেশ থাকবে আনন্দে আত্মহারা। এদিন জাতীয় ছুটির দিন। সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান ছুটি পালনের মাধ্যমে বর্ষবরণ পালন করছে। ঘরে ঘরে পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় কৃষাণ কৃষাণিদের মেলা বসবে। কৃষক হাসবে আর হাসাবে। নৌকা বাইছ হবে নদীতে। রাস্তাঘাট মুখোরিত থাকবে। কী আনন্দ কী মজা হবে চারিদিকে শুধু আনন্দ আর আনন্দ। ভাষা এবং বর্ষবরণ দুটোই জাতীর আনন্দের দিন। একটার সাথে অন্যটার সম্পর্ক বিদ্যমান। বাংলা ভাষা বর্ষবরণ সবকিছুই বাঙ্গালীর গৌরব আর অর্জন। এ অর্জন সমম্মিলিত অর্জন, এখানে কাউকে খাটো করা যাবে না। সব ধর্ম গোত্র পেশার শ্রেণি মানুষের সম্মিলিত অর্জন বর্ষবরণ।
সব ধর্মের মানুষ এ দিবসকে ভালোবাসে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় পালন করে থাকে। আরবি ইংরেজী পৃথিবীর অন্য ভাষা আমরা জানব, শিখব, অর্জন করবো। কিন্তু আমার বাংলা বর্ষবরণ আমাদের নিকট অন্যরকম আনন্দ। এ আনন্দ মায়ের ভালোবাসার আনন্দের চেয়েও কোনভাবেই কম নয়। সব পেশার মানুষ যে যার মত করে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান পালন করে থাকি। ধর্মের সাথে বর্ষবরণের কোন পার্থক্য নেই। এ অনুষ্ঠানে ধর্মকে ব্যবহার করে সংঘর্ষিক করার কোন কারণ দেখছি না। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান যে কেউ যার যার ধর্ম পালন করবে সেটাই স্বাভাবিক। বর্ষবরণ ধর্মের সাথে সেখানে সাংঘর্ষিক হবে না। বর্ষবরণ অর্থ অন্য কোন ধর্মের আচার অনুষ্ঠান পালন করার সংস্কৃতি না। এখানে নির্দ্দিষ্ট কোনো ধর্মিয় আচার অনুষ্ঠান পালন করে বর্ষবরণ করতে হবে এমন কোন প্রথা নাই। বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হলো, কৃষকের, দিনমজুরের, লাঙ্গল আর জেলেদের কথা বলার আনন্দ। কোনো ধর্মই এখানে আনন্দ আর ভালোবাসার হাসি হাসতে নিষেধ করছে না। বর্ষবরণ উদযাপনে ধর্মীয় কোনো বাধা নিষেধ নাই। যারা ধর্মের কথা বলে বর্ষবরণ সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়ায় তারা বর্ষবরণ কী তা বুঝে না। বর্ষবরণের সাথে যারা ধর্মকে জড়ায় তারাও ধর্ম কী চায় ধর্মের দাবী কী সেটাও বুঝে না। ধর্ম হলো মানুষকে ভালোবাসার নাম। মানুষকে না ঠকানো। মানুষের অধিকার দেয়া তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। কারো স্বাধীন অধিকার খর্ব না করা। ধর্মের দোহাই দিয়ে বাঙ্গালীর জাতীয় দিবসকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোন যৌক্তিকতা নাই। বাঙ্গালী জাতির বর্ষবরণ আর বিদায়ের সাথে ধর্মীয় কোনো বাধা নিষেধ আছে বলে আমার জানা নাই। পৃথিবীতে সকল ধর্মের মানুষ তাদের ভাষা আর সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলে আর অনুষ্ঠান করে থাকে। আনন্দ উৎসব পালন করে থাকে, বাঙ্গালী জাতি তাদের বাংলা নববর্ষের আনন্দ উৎসব করবে সেটাই স্বাভাবিক। এখানে ধর্মের ব্যবহার আবার ধর্মের প্রতিবন্ধকতা আছে বলে আমার মনে হয় না। রাজনৈতিকভাবে সুবিধা আদায়ের উদ্দেশ্যে কতিপয় সংস্কৃতিক সংগঠন ধর্মের দোহাই দিয়ে আমাদের আবহমান কাল থেকে চলে আসা সংস্কৃতির বিপক্ষে কথা বলে থাকে। এসব কথার কোন ভিত্তি নাই। মসজিদ মন্দির, গীর্জায় যার যার ধর্ম সে পালন করবে। বাঙ্গালীর সংস্কৃতির একটা ঐতিহ্য আছে, সব শ্রেণির পেশার মানুষ এটা সর্বাত্তক ভাবে পালন করে। এখানে ধর্মীয় কোনো আবেগ নিষেধ নাই। বৈশাখ পালনের মাধ্যমে কোনো ধর্ম বিরোধী ব্যাখ্যাও নাই। নিচক এটা একটা জাতীয় ও ঐতিহাসিক সংস্কৃতির দিন। জাতীয় দিবস হিসেবে জাতীয় ভাবে পালন ও বাস্তবায়ন আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ধর্মিয় নিয়মের কথা বলে ধর্মকে এখানে ব্যবহার করা কোনো অবস্থায় কাম্য নয়। আবার যারা বিশেষ একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ছত্রছায়ায় বর্ষবরণকে ব্যবহার করার চেষ্টা করে থাকে সেটাও নিন্দনীয়। রাষ্ট্র যখন সকলের, অনুরূপ ভাবে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান সকলকে ভেদাভেদ ভুলে একযোগে পালন করতে হবে। সেটাই জাতীয় দাবি আর বাঙ্গালীর সংস্কৃতি।
এ সংস্কৃতি কোনো একক ধর্মের অনুষ্ঠান নয়। এটা জাতীয় অনুষ্ঠান। সার্বজনীন অনুষ্ঠান। বাঙ্গালী সংস্কৃতির মধ্যে বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রবেশ বাঙ্গালী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বড় ধরণের আঘাত। বিজাতীয় সংস্কৃতি যা, সংখ্যাঘরিষ্ট মানুষের আদর্শ, চরিত্র মননশীলতার সাথে সাংঘর্ষিক সেটাকে এ জাতি বাঙ্গালী সংস্কৃতি হিসেবে মেনে নিবে না। গ্রহণ ও করতে পারে না। বাঙ্গালী সংস্কৃতির নামে অন্য ধর্মের কালচার সভ্যতা, সংখ্যাঘরিষ্ট জনগোষ্ঠির উপর চাপিয়ে দেয়া সংস্কৃতির নাম নয়। ধর্ম, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি সব কিছুকে এক করে ফেল্লে সেখানে ঝামেলা বাঁধবে। বাংলাদেশে বহু ধর্মের লোকের বসবাস। সকলেই এখানে যার যার ধর্ম পালন করছে। কাউকে কোনো বাঁধা সৃষ্টি করা হয় না ধর্ম পালনে। ধর্মের আচার অনুষ্ঠান ও ভিন্ন। এক ধর্মের আচার অনুষ্ঠান অন্য ধর্মের লোকেরা করে না। এখানে সংস্কৃতির নামে অন্য ধর্মের অনুষ্ঠানমালা চালিয়ে দেয়াটা বাঙ্গালীর সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে না। এ ধরণের অনুষ্ঠান হলে সেখানে ধর্মীয় ভাবে বিশৃংখলা হবে। সংখ্যা ঘরিষ্ট ধর্মের বিশ্বাসী সেটাকে গ্রহণ করবে না। তারা তার প্রতিবাদ ও করতে পারে। নির্দ্দিষ্ট কোনো ধর্মের আচার অনুষ্ঠানকে নিচক সংস্কৃতির নামে জাতির উপর চাপিয়ে দেয়ার নাম বাঙ্গালী সংস্কৃতি হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। বাঙ্গালী সংস্কৃতির আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে এবং থাকবে। এখানে সকল ধর্মের মানুষ যেন সেটা পালন ও অংশগ্রহণ করতে পারে আমাদের সেটাই দেখতে হবে। সংখ্যা গরিষ্ট ধর্মের অনুসারীদের আদর্শের কথা চিন্তা করে সংস্কৃতি পালন করতে হবে। মুসলিম ধর্মের তাহযিব তমদ্দুনের প্রতি আঘাত ও বিরোপ আচার আচরণ করে সংস্কৃতি হতে পারে না। দেখা যায় কতিপয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মুসলমানদের ধর্মের ব্যবহারকে নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রোপ, হাসিতামাসা করে অনুষ্ঠান করা হয়। সেটা জাতীয় সংস্কৃতি হতে পারে না। সংস্কৃতির একটা মননশীলতা রুচি থাকতে হবে। সেখানে শালিনাতা দেখাতে হবে। অরুচি, অভদ্র, অন্য ধর্মের আচার অনুষ্ঠানকে হেয় করে চরিত্র প্রদর্শন করা সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে না। ধর্মীয় বিভাজন নয়, সব ধর্মের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব চাই। ধর্ম মানুষকে শান্তি শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করে। ভালোবাসা ও মহৎ হতে শিখায়। ধর্মের সকল বাণীতে তাই দেখা যায়। যারা সংস্কৃতির নামেই অপর ধর্মের কালচার কে ভিন্নভাবে মানুষের সমানে তুলে ধরে তারা প্রকৃত ধর্মের অপব্যাখ্যা করছে। ধর্ম অনুসরণ ও ধর্ম পালন খারাপ কিছু না। ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক নীতিই খারাপ। কোনো ধর্ম মানবতাকে ধ্বংস করার কথা বলে না। তা হলে আমরা কেন সংস্কৃতির কথা বলে ভিনদেশী সংস্কৃতির চর্চা করে ধর্মে ধর্মে বিভাজন সৃষ্টি করছি! সংস্কৃতি হতে হবে ধর্মিয় নিয়ম নীতি বান্ধব। ধর্ম বিরোধী নয়। এখন সংস্কৃতি বললেই ধর্মকে দু চারটা চড়-তাপ্পড় মারলেই সফল। এধরণের সংস্কৃতি থেকে বাঙ্গালী জাতি মুক্তি চায়। বাঁচতে হবে, বাঁচাতে হবে আগ্রাসী এ সংস্কৃতির জাল থেকে এ জাতিকে। আমাদের সংস্কৃতি হতে হবে শ্রমিক, কৃষক, জেলে, কামারি, কুমারি বান্ধব। সর্বোপরি সংখ্যা গরিষ্ট ধর্মীয় মানুষের ঈমান আক্বিদা বিধ্বংসী সংস্কৃতি পরিহার করতে হবে। সংস্কৃতিতে সব মানুষের আদর্শ, চরিত্র, চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটাতে পারলেই জাতি সংস্কৃতি পালনে সফল হবে।
অন্যদেশের সংস্কৃতির আদর্শ আমদানী করে নিজস্ব সংস্কৃতিকে পদদলিত করে অপসংস্কৃতি বাস্তবায়ন গ্রহণযোগ্য নয়। নামায, আজান, মিম্বর, পাগড়ি, মুসলিম সংস্কৃতি সভ্যতার অংশ। এগুলোকে হেয় করে নাটক থিয়েটার পরিবেশন মুসলিম সমাজে কাম্য নয়। হিযাব নারীদের শালীনতা শিখায়। হিযাব ব্যবহার করে কেউ কেউ হিযাব বিরোধী কাজ করতেও পারে সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাই বলে সমস্ত হিযাব ব্যবহারকারী নারী সমাজ সমালোচিত হবে কেন? হিযাব ইসলামের একটা ফরজ বিধান। যা মহিলারা ইজ্জত আবরু রক্ষায় ব্যবহার করে থাকে। এটাকে খাটো করে ভিন্ন চরিত্র দিয়ে ইসলামী সভ্যতা আর সংস্কৃতিকে সমালোচনার বস্তুতে পরিণত করা গ্রহণযোগ্য নয়। একই ভাবে সকল ধর্ম যার যার নিয়ম-নীতি মতে চলবে। এখানে ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের পক্ষ থেকে কোনো বাধা প্রতিবন্ধকতা নেই। বাধা হচ্ছে ইসলামী তাহযীব তামদ্দুনকে নিয়ে যখন নাটক, থিয়েটার, গান মঞ্চস্থ করা হয়, তখন ইসলামের অনুসারীদের সেখানে বিরোপ ভাবে প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। একটি সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য অপর একটি প্রতিষ্ঠিত ধর্মের অনুসারিদের উপর আঘাত মেনে নেয়া যায় না। খেলা-ধুলাসহ যে কোনো সংস্কৃতি অনুষ্ঠান হোক না কেন সেখানে ইসলাম ধর্মের কোনো বাঁধা নেই। বাঁধা হচ্ছে যখন ইসলাম ধর্মের নিয়ম-নীতি চরিত্র নিয়ে বিদ্রোপ করা হয় তখন। এধরণের খারাপ ও নষ্ট চরিত্র ধারণ করে অনুষ্ঠান না করা ভালো। সকল অনুষ্ঠান সংস্কৃতি হোক জাতির ঐক্যভিত্তি। বিভাজনের সংস্কৃতি জাতি চায় না। সকল ধর্মের মানুষের মাঝে ঐক্য, শান্তি, একতা, ভ্রাত্তিত্ব প্রতিষ্ঠা হউক সেটাই নববর্ষের দিবস উদযাপনের প্রত্যাশা।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply