চাঁদাবাজি বন্ধ না হলে সড়ক দূর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব না
হাসি খুশি ছেলে-মেয়ে গুলো বাসা থেকে বের হয়, স্কুল কলেজে জন্য আর লাশ হয়ে ফিরে আসে। কর্মস্থলে যাওয়ার বা ফেরার পথে থেতলে যাচ্ছে মাথা, কাটা পড়ছে শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গ। আবার আহত যাত্রীকে নদীতে ফেলে দিচ্ছে পরিবহন শ্রমিক। প্রতিদিন এরকম মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। কোন ভাবে সড়ক দূর্ঘটনা প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। কেন, আমাদের প্রশাসনে কি পর্যাপ্ত পরিমানের জনবল নেই? না-কি তাদের কাজ শুধু বাস ট্রাক থামিয়ে চাঁদা সংগ্রহ করা পর্যন্ত। নির্দিষ্ট পরিমানের চাঁদা পরিশোধ করলে পরিবহনের ড্রাইভার কে, তার বয়স কত, যোগ্যতা বা লাইসেন্স আছে কিনা এসব দেখার আর প্রয়োজন হয় না। জনবহুল শহরে গনপরিবহন গুলোর চলাচলের ভয়াবহতা দিনে দিনে মারাত্মক হয়ে উঠছে। কি এক কারনে পরিবহন শ্রমিকেরা পথচারি বা যাত্রীদের আর মানুষ ভাবতে রাজি না।
গনপরিবহনের আমাদের প্রয়োজন আছে। দেশের সব বাবা-মায়ের তো আর প্যারাডো, আউটল্যান্ডার, এলিয়েন অথবা ল্যান্ডরোভার কেনার সামর্থ নেই। তাই এসব গনপরিবহনের আমাদের অতন্ত প্রয়োজন। আর সেই পরিবহনই যদি বারবার মৃত্যুর কারন হয় তাহলে নিশ্চই এর পেছনে কোন গুরু সমস্যা আছে যা আমরা দেখেও না দেখার ভান করে থাকি। কারন যাদের প্রান যাচ্ছে তারা আমাদের পরিবারের কেউ না। আমরা অনুভব করার চেষ্টা করিনা, সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত মানুষটা কারও ছেলে, কারও মেয়ে, কারও বাবা আবার কারও মা। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে আমাদেরও তাদের মত পথের পার্শ্বে দাঁড়ীয়ে গন পরিবহনের অপেক্ষা করতে হয় গন্তব্যে পৌছানোর জন্য। গন পরিবহন আমাদের আধুনিক জীবনে যোগাযোগের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ।
জনসংখ্যা অনুযায়ী পরিবহনের সংখ্যা পর্যাপ্ত থাকলেও যানজট আর বেহাল সড়কের কারনে নির্দিষ্ট সময়ে নিদিষ্ট গন্তব্যে পৌছানো বাংলাদেশে এখন স্বপ্নের বিষয়। পরিবহন দেশের এমন একটা সেক্টর যার উপর নির্ভর করে দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবিকা চলে। দেশের সরকার থেকে নাট-বোল্ট বিক্রেতা পর্যন্ত এই সেক্টর থেকে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি আয় করছে। পরিবহন সেক্টর হচ্ছে দেশের একমাত্র কাঁচা টাকা তৈরির কারখানা। তারপরও এখন পর্যন্ত পরিবহন সেক্টর দেশের সবচেয়ে বিপদজনক একটি মাধ্যম হয়ে আছে। যার কারনে রাস্তাঘাটে চলাচল এখন রিতিমত ভিতির কারন।
যেহেতু পরিবহন সেক্টর দেশের একমাত্র কাঁচা টাকা আয়ের কারখানা হিসেবে পরাচিত, এটাকে ঘিরে বেশ কিছু চক্র তৈরি হয়েছে। যারা এখান থেকে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা চাঁদা সংগ্রহ করছে। এদের মধ্যে বিভিন্ন মালিক সমিতি, শ্রমিক সমিতি, বিভিন্ন ক্লাব, এলাকার রংবাজ, এমনকি মসজিদ মাদ্রাসার নামেও চাঁদা তোলা হচ্ছে। বাংলাদেশে মোট কত গুলো গাড়ী গনপরিবহন হিসেবে পরিচালিক হচ্ছে তার সঠিক হিসেব এই সেক্টরে নিয়োজিত কর্মকর্তারাও ঠিক মত দিতে পারবে না। বৌধ পরিবহনের চেয়ে অবৈধ পরিবহনের সংখ্যাই বেশি, যার প্রধান কারন প্রশাসন। প্রশাসনের কিছু লোকজন প্রতিদিন চাঁদা কালেক্সন করছে, আবার কোন কোন স্থানে মাসহারা চাঁদা তোলা হয়। চাঁদা দিলে যদি গাড়ী চালানো যায় তাহলে লাইসেন্স আর রেজিস্ট্রেশনের প্রয়োজন কি। আর ট্রাফিক আইন-ইবা কেন মানবে।
মালিকরা গাড়ী কিনে শ্রমিকদের হাতে ছেড়ে দেয়, কোন কোন মালিকের লোক থাকে গাড়ী গুলো মনিটরিং করার জন্য, আবার কারও থাকে না। যাদের থাকে না তাদের গাড়ী বা গাড়ী গুলো সম্পূর্ণ পরিবহন শ্রমিক কতৃত পরিচালিত। কেউ কেউ শ্রমিকদের সাথে মাসিক চুক্তি করে থাকে। তাই গাড়ী কে চালাচ্ছে, তার লাইসেন্স আছে কি-না এসব বিষয়ে মালিকদের তেমন কিছু জানা থাকে না। দেশে পরিবহন মালিকরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লাভবান হয় না। পথে পথে পয়েন্টে পয়েন্টে চাঁদা দিয়ে চুরি করে যেটুকু বাঁচে তা মালিকের ঘরে। যাদের পরিবহন খাতে অনেক গুলো গাড়ী নিয়োজিত তাদের ব্যপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। দু একটা গাড়ীর মালিকদের গাড়ী গুলো তাদের নিয়ত্রনে খুব কমই থাকে। এটাই বারবার দূর্ঘটনার কারন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অযোগ্য ড্রাইভার গাড়ীর নিয়ত্রন হাতে পেলে মানুষকে আর মানুষ মনে করে না। নেশা এখন সহজ প্রাপ্প আর বেশির ভাগ শ্রমিক নেশা করে তাদের হাতে বাস বা ট্রাক তখন উডজাহাজ হয়ে যায়, রাস্তাকে আকাশ ভাবে।
আজ যে হেলপার কাল সে ড্রাইভার, শ্রমিক সমিতি গুলোর সদস্য হলে লাইসেন্সের খুব একটা প্রয়োজন হয় না। আর চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট মেইনটেইন করলে তো তার পোয়াবারো অবস্থা। তখন সে বা তারা রাস্তার রাজা বনে যাচ্ছে। দূর্ঘটনা কবলিত পরিবহনের দায়ভার মালিককে বহন করতে হয়, মামলা চলতে থাকে। অভিযুক্ত ড্রাইভার অন্য পরিবহরের নিয়ন্ত্রন হাতে নেয়। সচেতন মালিকরা তাদের পরিবহন রেজিস্ট্রেশন চালু রাখে। তবে তাদের পরিমান দেশে কমে যাচ্ছে। কারন প্রতিটি গাড়ীর বাৎসরিক ফিটনেস, ট্যাক্সটোকেন আর রেজিস্ট্রেশন আপটুডেট ফি’র যে পরিমান নির্ধারন করা হয়েছে তা তারা সংগ্রহ করতে হিমসিম খাচ্ছে, কারন একটাই চাঁদাবাজি। পরিবহনের চলাচল এবং মনিটরিং করার জন্য সরকার যাদের নিয়োজিত করেছে তাদের ভেতরে স্বচ্ছতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। আমরা প্রায়ই টিভিতে কিংবা অনলাইনে প্রশাসনের চাঁদাবাজির পরিস্কার চিত্র দেখে আসছি।
সড়ক দূর্ঘটনায় আজ যেই মানুষটার মৃত্যু হবে তার জন্য কে দায়ী? সে তো কারও ছেলে, মেয়ে, বাবা, অথবা মা। তার পরিবারের প্রতি, দেশের প্রতি তার একটা দায়ীত্ব থাকে, যা তাকে পূরণ না করেই বিদায় নিতে হচ্ছে। গতকাল যাদের মুত্যু হয়েছে বা তার আগে, তাদেরও তো একই অবস্থায় চলে যেতে হয়েছে। তাহলে কি তারা শহীদ উপাধি পাওয়া উচিৎ নয়। তারা বারবার মরে আমাদের সাবধান করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমরা কতটিক সাবধান হয়েছি, পারছি কি সড়ক দূর্ঘটনা নিয়ত্রন করতে? আমি অন্যায় কিছু করলে মানুষ আমার পরিবার প্রধানের দোষ দেবে, আমার সন্তান অন্যায় কিছু করলে মানুষ আমার দোষ দেবে, এটাই স্বাভাবিক। চাঁদাবাজির কারনে সড়ক দূর্ঘটনায় দেশে প্রতিদিন বহু মানুষের প্রান হারানোর ঘটনার দোষ মানুষ সরকার প্রধানকেই দিচ্ছে। বাংলাদেশে অনিয়ত্রিত যানবাহন চলাচল অবস্থা ব্যবস্থা কবে নাগাদ নিয়ত্রনে আসবে তা কোন গনকের পক্ষের গননা করা সম্ভবনা। এও বলা সম্ভব না কেবে নাগাদ সড়ক দূর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু বন্ধ হবে। তবে এটা পরিস্কার করে বলা সম্ভব যে, বাংলাদেশে চাঁদাবাজি বন্ধ না হলে সড়ক দুর্ঘটনা কোন ভাবে এড়ানো সম্ভব হবে না।