২৯ মার্চ ২০২৪ / ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ / দুপুর ২:১৩/ শুক্রবার
মার্চ ২৯, ২০২৪ ২:১৩ অপরাহ্ণ

এবার ধরা পড়ল গডফাদার : সুগন্ধায় তার ছয় তলা ভবন ।। গভীর সাগর থেকে ট্রলারভর্তি ২০ লাখ ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার ৯

     

এম নুরুল ইসলাম, আনোয়ারা

বঙ্গোপসাগরে একটি মাছ ধরার ট্রলার থেকে ২০ লাখ ইয়াবাসহ আট জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। গতকাল রোববার ভোরে র‌্যাবের একটি দল গভীর সাগরে অভিযান চালিয়ে এ যাবৎকালের অন্যতম বৃহৎ এই চালান আটক করে। পরে তাদের স্বীকারোক্তি মতে, ইয়াবা চালানের অন্যতম মালিক মোজাহেরকে (৫৭) পাঁচলাইশ সুগন্ধার বাসা থেকে আটক করা হয়। র‌্যাব৭ এর অধিনায়ক লে: কর্ণেল মিফতাহ উদ্দিন জানান, আটক মোজাহের আনোয়ারাগহিরা এলাকার ইয়াবা চোরাচালান চক্রের প্রধান। অভিযানে গ্রেপ্তারকৃত অন্যরা হল মকতুল হোসেন (৫০), মো. আব্দুর নূর (৩৭), হেলাল (২১), আব্দুল খালেদ (৬০), জানে আলম (৩২), লোকমান (৫৯), এনায়েত উল্লাহ (৭২) ও নুরুল মোস্তফা (২৬)। র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, এদের মধ্যে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার মকতুল হোসেন হলেন মোজাহারের ম্যানেজার। আব্দুর নূর এই ইয়াবা চালানের মালিকদের মধ্যে একজন। বাকি ছয়জনই আনোয়ারা উপজেলার বাসিন্দা। তারা ট্রলারেরমাঝিমাল্লা হিসাবে কাজ করত। ট্রলারটির মালিক জলিল প্রকাশ নুন জলিলকে গ্রেপ্তার করা যায়নি বলে র‌্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। উদ্ধার করা ২০ লাখ ইয়াবার মূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা।

গতকাল বিকেলে নগরীর পতেঙ্গায় র‌্যাব৭ এর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে পুরো অভিযান সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হয়। এসময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, র‌্যাবের অতিরিক্ত মহা পরিচালক আনোয়ার লতিফ খান, র‌্যাব৭ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ ও র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার প্রধান কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক ইয়াবা চালানের মধ্যে রোববার আটক হওয়া চালানটি দ্বিতীয় বড় চালান। এর আগে গত বছরের ১৭ জানুয়ারি একটি মাছ ধরার ট্রলার থেকে ২৭ লাখ ৫০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছিল র‌্যাব। সাম্প্রতিক সময়ে উদ্ধার হওয়া চালানের মধ্যে সেইটি ছিল সবচেয়ে বড়।

সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ইয়াবাগুলো ধরার পর পাচারকারী চক্রের মূল হোতাকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। তিনি সমাজে ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে ছিলেন। তার ছেলেমেয়েরাও ভালো স্কুল কলেজে পড়ে। তারাও হয়ত জানত না তাদের পিতা এ কাজ করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যতই আড়ালে আবডালে থাকুক, ইয়াবার সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরকে খুঁজে বের করা হবে। ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত যার নাম আসবে তাকে সমাজে ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, একদিকে ইয়াবা ব্যবসা করবেন অন্যদিকে সাধু সেজে থাকবেন তা সম্ভব হবে না। ভবিষ্যতেও যারা সমাজকে এভাবে দুই ধরনের চেহারা দেখাবেন, তাদের মুখোশ উন্মোচন করে দেওয়া হবে।

র‌্যাব৭ এর সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) এএসপি মিমতানুর রহমান জানান, আটক আনোয়ারাগহিরাকেন্দ্রিক ইয়াবা সিন্ডিকেটের প্রধান মোজাহের আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর এলাকার চান মিয়ার ছেলে। এলাকায় যিনি লোকজনের কাছে ভাল মানুষ হিসাবে পরিচিত। ভাল মানুষের মুখোশের আড়ালে সে ইয়াবা পাচারের কাজ করত।

র‌্যাবের দাবি, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের একটি সংঘবদ্ধ চক্র মাছের ব্যবসার আড়ালে ট্রলারে করে ইয়াবা নিয়ে চট্টগ্রামের উপকূলে আসে। সেগুলো আনোয়ারা উপকূল হয়ে খালাসের পর দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাচার করা হয়। বিভিন্ন সময় কয়েকটি চালান ধরা পড়লেও রাঘব বোয়ালরা এতদিন ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে।

সূত্রমতে, এবারের অভিযানে ২০ লাখ ইয়াবা ধরা পড়লেও গত চার মাসে মোট ৭৬ লাখ ইয়াবার চারটি চালান খালাস করেছে এই সিন্ডিকেট। সাম্প্রতিক সময়ে আনোয়ারায় খালাস হওয়া প্রায় সব ইয়াবা চালানের নেপথ্যে এই সিন্ডিকেটটি কাজ করেছে বলে জানা গেছে।

যেভাবে ধরা পড়ে চালানটি :

গ্রেপ্তার ইয়াবা পাচারকারী চক্রের সদস্যরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এই চক্রে তিন মিয়ানমারের নাগরিক থাকার কথা র‌্যাবকে জানিয়েছে। মিয়ানমারের নাগরিক শুক্কুর, লাল মিয়া এবং মগ ওরফে সেন্সু এই চালানটি পাঠিয়েছিল। এরমধ্যে ৭ এপ্রিল রাত ১০টায় মগ ওরফে সেন্সু এফভি মোহছেন আউলিয়া ট্রলারে করে নগরীর ফিশারি ঘাট থেকে রওনা হয়। এসময় জাহাজে মোজাহার বাদে গ্রেপ্তার অন্যরাও ছিল। ট্রলারটি কর্ণফুলী নদী ধরে কুতুবদিয়া, কক্সবাজার, টেকনাফ, শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিন হয়ে ছেঁড়াদ্বীপের পশ্চিমে মিয়ানমারের পচাখালির বাতির বাহির এলাকায় পৌঁছায়।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ জানান, সেখানে মিয়ানমারের একটি তেলের জাহাজ থেকে ইয়াবা এই ট্রলারে তুলে দিয়ে সেন্সু ওই জাহাজেই থেকে যায়। পরে অন্যরা ট্রলারটি নিয়ে দক্ষিণ হাতিয়া দ্বীপের কাছে মোক্তারিয়া এলাকায় আসে। তারা কাটালিয়া হয়ে আনোয়ারাগহিরার দিকে আসছিল।

জানা গেছে, ট্রলারটি মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে গিয়ে অবস্থান করছিল। রাডারে ট্রলারটির অবস্থান ধরা পড়ে। ওই ট্রলারে জাল থাকলেও কোনো মাছ ছিল না। কয়েকটি বস্তার মধ্যে ছিল এসব ইয়াবার প্যাকেট।”

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, যদিও র‌্যাবের কাছে সমুদ্রগামী জাহাজ নেই। ছোটখাটো বোট আছে। তবুও তারা ভয়াবহ মাদক ইয়াবার বিস্তার রোধে সফলতা দেখাচ্ছে।

চট্টগ্রাম শহরে মোজাহেরের ছয়তলা বাড়ি :

গ্রেপ্তার হওয়া ইয়াবা সিন্ডিকেটের প্রধান মো. মোজাহারের নগরীতে আছে ছয় তলা বাড়ি। এর দ্বিতীয় তলায় তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন। জানা যায়, আটক হওয়া ইয়াবা চালানটির মালিক ৩ জন। এর মধ্যে মোজাহের একজন। র‌্যাব৭ এর উপঅধিনায়ক স্কোয়াড্রন লিডার সাফায়াত জামিল ফাহিম সাংবাদিকদের বলেন, মোজাহারের দাবি তার খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজমরিচমসলার ব্যবসা ছিল এবং বর্তমানে সে শাড়িকাপড়ের ব্যবসা করে। তার এক সন্তান অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। অন্য সন্তান ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে।

চার মাসে ৭৬ লাখ ইয়াবা খালাস:

জানা যায়, মোজাহার, জলিল ও আব্দুর নূর মিলে ডিসেম্বর মাসে ১৬ লাখ এবং জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে তিন চালানের প্রতিটিতে ২০ লাখ করে আরও ৬০ লাখ ইয়াবা খালাস করেছিল। লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন বলেন, তাদের সাথে আনোয়ারাগহিরার সবুর, কালা মনু, ফয়েজ, সেলিম, জাহাঙ্গীর, জালাল, লেদু এবং মনুসহ আরও কয়েরকজন আছে। আনোয়ারাগহিরায় কয়েকটি মাদক ব্যবসায়ী চক্র সক্রিয়। তাদের মধ্যে সবেচেয়ে বড় চক্রটি মোজাহারের।

মোজাহের ও নুন জলিলের বেড়ে উঠা : স্থানীয়রা জানান, ১৯৮১৮২ সালের দিকে টেকনাফের তৎকালীন এক শীর্ষ চোরাকারবারীর হাত ধরে আনোয়ারার রায়পুরের বাসিন্দা মোজাহের, আবদুল জলিল প্রকাশ নুন জলিলসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে চোরাচালানী সিন্ডিকেট গড়ে উঠে। তারা নদী, সাগর পথে স্বর্ণ চোরাচালান, মাদক পাচার, ইলেকট্রনিক সামগ্রী সিগারেট ও বিদেশী মদ সহ নিষিদ্ধ মালামাল পাচার শুরু করে। কয়েক বছরের মধ্যে এ সিন্ডিকেট অপরাপর চোরাচালানী সিন্ডিকেটকে টপকে শীর্ষস্থান দখল করে। তার স্বীকৃতি হিসেবে টেকনাফের ওই গডফাদার চট্টগ্রামের খুলশীতে সিন্ডিকেটের প্রত্যেক সদস্যকে একটি বাড়ি উপহার দেয়। পরবর্তীতে জলিল তার বাড়িটি বিক্রি করে দিলেও অন্যান্যরা সেখানে বহাল তবিয়তে বসবাস করছে।

৯০ দশকের পর থেকে চোরাচালানী ব্যবসা তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এদের কেউ কেউ প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়ে এই পেশা ছেড়ে দিলেও মোজাহের ও জলিল ছিল বরাবরই সক্রিয়। মোজাহের ও জলিল গত ৭/৮ বছর ধরে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে চট্টগ্রামের শীর্ষ আড়তদারের স্থান দখল করে নেয়। মোজাহের পারিবারিকভাবে স্বচ্চল হলেও এ পেশায় জড়িয়ে বর্তমানে সে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে। চট্টগ্রামে বসে সে পুরো দেশের বিভিন্ন পয়েন্টে এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে।

আবদুল জলিল প্রকাশ নুন জলিল রায়পুরের মৃত সাচি মিয়ার ১ম পুত্র। অভাবঅনটনের পরিবারে তার জন্ম। অতি ছোটকালে বাজারে ফেরি করে করে পান বিক্রি করত। এরপর বিক্রি করত লবণ। বর্তমানে জলিল কোটি কোটি টাকার অর্থবিত্তের মালিক বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে।সৌজন্য আজাদী

 

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply