২৬ এপ্রিল ২০২৪ / ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ভোর ৫:৫৫/ শুক্রবার
এপ্রিল ২৬, ২০২৪ ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বনবির মিরাজ বর্তমান মহাকাশ অভিযানের দ্বার উন্মোচন

     

অধ্যক্ষ মুহাম্মদ ইউনুছ কুতুবী

মিরাজ ছিল মহানবি (স) এর জীবনের এক মহান উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আর নবি (স) মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল আলমে গায়েব-আলমে একাবনের ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আর এর ব্যবস্থাপক ছিলেন স্বয়ং সর্বশক্তিমান আল্লাহ। মহান আল্লাহ নবুয়তের গুরুদায়িত্ব এবং খিলাফত পালনের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য ট্রেনিং দেওয়ার উদ্দেশ্যে তার রহমতের সর্বাধিক সান্নিধ্যে ডেকে এনেছিলেন প্রিয় নবি (স)-কে স্বয়ং আল্লাহ জাল্লাহ শানুহ। তিনি তাকে যাবতীয় শিক্ষাদান করে এক পর্যায়ে সৃষ্টির তাবত রহস্য প্রদর্শনের জন্য সমগ্র বিশ্বজগৎ পরিভ্রমণ করান। এমনকি তাঁর নিকটত্ব, মাহাত্ম ও কুদরাতের কেন্দ্র আরশ আজিমে নিয়ে গিয়ে তার সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে মিলিত হন যাকে বলা যায় মহামিলনের রাত। নবি (স) এর এ অনন্য ঘটনায় মিরাজুন নবি নামে পরিচিত। কিন্তু কিভাবে এ ঘটনা ঘটেছিল? কী ঘটেছিল সে রাতে? বর্তমান বিজ্ঞানের যুগেও একজন মানুষ উন্নতমানের বিশেষ কোনো প্রক্রিয়া ছাড়া উর্ধ্বাকাশে আরোহন করা এবং তথাকার আবহাওয়ার মধ্যে টিকে থাকা সম্ভব নয়। আজ থেকে প্রায় পনেরশ বছর পূর্বে যে সময়ে গাড়ি উন্নত যানবাহন কিংবা উড়োজাহাজ কিছুই ছিল না, নাহি ছিল চীন, রাশিয়া বা আমেরিকার রকেট। একজন মানুষ কী করে একই রাতের মধ্যে ঊর্ধ্বোজগৎ, সিদরাতুল মুনতাহ, মাকামে মাহমুদ এবং আরশে আজিমে আরোহণপূর্বক মহান প্রভূর সান্নিধ্যে লাভে ধন্য হল। আবার পুনরায় ফিরে এসে দুনিয়ার জগতে স্বাভাবিক জীবনযাপন আরম্ভ করল, এসব যেন কল্পনা প্রসূত। অথচ এর সবকিছুই সম্ভব হয়েছিল পবিত্র মেরাজ রজনীতে। এ মেরাজের ঘটনাটি আল্লাহ পাক কুরআন মজিদের পনের পরায় এভাবে বর্ণনা করেছেন, “পবিত্র তিনি যিনি তার বান্দাকে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত রাত্রিকালে ভ্রমণ করিয়েছেন যার চারদিকে আমি বরকতময় করেছিলাম যাতে করে আমি তাকে আমার কুদরাতের কিছু নির্দশন দেখাই, নিশ্চয় তিনি সর্বদ্রষ্টা।”
সমকালীন বিশ্বের বিস্ময়ের বিস্ময় মহাকাশ অভিযান চলছে। মানুষ চন্দ্রে ভ্রমণ করেছে মঙ্গলগ্রহে অভিযান চালাচ্ছে মহাকাশের বিভিন্ন গ্রহে ভ্রমণের জন্য। আবিষ্কারের জন্য মহাকাশযান নভোযান পাঠাচ্ছেন, প্রাণি পাঠাচ্ছেন মূলত এসব অভিযানের দ্বার উন্মোচক মহানবি (স) এর পবিত্র মিরাজ। এ মিরাজ আজকের বিজ্ঞানীদের গবেষণার দ্বার খুলে দিয়েছে। বিশেষ করে মহাকাশ গবেষক, বিজ্ঞানীদের এ পথে আগ্রহী করে তুলেছে। যুগ যুগ ধরে বিশ্বজয়ী মহাকাশ বিজয় প্রত্যাশী অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞানীদের গবেষণা তৎপরতা এখন তাদেরকে ভূমণ্ডল থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে নভোমণ্ডলের অজানা অচেনা পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
অনেকে মনে করে থাকেন মানুষের পক্ষে মহাশূন্য অতিক্রম করা সম্ভব। নীল আর্মস্ট্রং, অ্যাডওয়ার্ড অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্স কিভাবে চাঁদের পিঠে ভ্রমণ করেছেন?
মহাকাশে এ পর্যন্ত যা আবিষ্কৃত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে যা হবে সবকিছুর মূলে রয়েছে মহানবি (স) এর মিরাজ শরীফ। ১৫০০ বছর পূর্বে বিশ্বনবি (স) আরশ আজীমে মহাপ্রভুর মহামিলনে গমন করলে মহাকাশের পথ উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য উন্মুক্ত হয়, আর এটাই হচ্ছে বিজ্ঞানীদের মহাকাশ যাত্রার প্রধান অবলম্বন। বলতে দ্বিধা নেই যে, মহাবিজ্ঞানী মহানবি (স) আরশ আজীমে গেছেন বলেই তার উম্মতরা আজ মঙ্গল গ্রহসহ বিভিন্ন গ্রহে যাওয়ার পথ পেয়েছেন। শ্রেষ্ঠ নবির উম্মত হিসেবে এটা আমাদের জন্যও গৌরবের। ১৯৫৯ সালে নীল আর্মস্ট্রং, মাইকেল কলিন্স, অলড্রিনকে চন্দ্রপৃষ্ঠের বায়ুমণ্ডল আবহাওয়া তথা পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর উপযোগী করে তোলা হয়েছিল এবং তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল তাও মহানবি (স)-কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেভাবে ঊর্ধ্বাকাশে নেওয়ার জন্য গড়ে তুলেছিল তার বক্ষে হাউজে কাউসারে পানি দিয়ে ধৌত করে নূর প্রবেশ করিয়ে। ঐ নূরের বদৌলতে আল্লাহ পাক তার হাবীবকে মহাশূন্যে ভ্রমণের উপযোগী করে গড়ে তুলেছিলেন এবং ঊর্ধ্বাকাশে ভ্রমণ করিয়েছিলেন, ঠিক সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে তারাও চন্দ্রপৃষ্ঠে ভ্রমণ করেছিলেন। মানুষের পক্ষে মহাশূন্যের সীমানা অতিক্রম করা সম্ভব নয় বলে ধারণা থাকলেও আমরা বলতে পারি আল্লাহর দেওয়া জ্ঞানের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা যে রকেট তৈরি করে সে রকেট যদি মাধ্যাকর্ষণ ভেদ করে চন্দ্রপৃষ্ঠ ভ্রমণ করতে পারে এবং মঙ্গলগ্রহে অভিযান চালিয়ে উপগ্রহ আবিষ্কার করতে পারে, তাহলে সারাজাহানের সৃষ্টিকর্তার পক্ষে তার শ্রেষ্ঠ মহিমান্বিত বান্দা হাবীবকে মহাশূন্যে ভ্রমণ করিয়েছেন তা আর অসম্ভব কী? সুতরাং এতে বুঝা যায় বিশ্বনবির মেরাজই হলো আজকের মহাকাশ অভিযানের দুয়ার উন্মোচন। তাই মিরাজের অন্যতম শিক্ষা হলো বিজ্ঞান চর্চা। মিরাজ যদিও নভোমণ্ডলে ভ্রমণ তবে মানবজাতির ইতিহাসে যত ভ্রমণকারীর আবির্ভাব হয়েছে বা হবে তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ভ্রমণকারী হলেন আমাদের প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মদ (স) কতদূর গিয়েছিলেন তা আমাদের কল্পনারও বাইরে। তবে মিরাজের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষের অসাধারণ শক্তির সম্ভবনা জানিয়ে দিয়েছেন। মানুষ তাই দেশভ্রমণ ও নভোমণ্ডল পরিভ্রমণের মাধ্যমে নবি (স) শুভ মতই পালন করেন। মানুষ গবেষণা ও বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে শুধু যে উপগ্রহ ও চাঁদে যেতে পারে তাই নয় গ্রহ নক্ষত্রের মত জগত পার হয়ে আরো ঊর্ধ্বে যেতে পারে, তার ইঙ্গিতই মেরাজে রয়েছে।
মূলত মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার প্রিয় হাবীব রাসূল (স)-কে পবিত্র মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা হয়ে বোরাকের মাধ্যমে সিদরাতুল মুনতাহা হয়ে সপ্ত আসমান পাড়ি দিয়ে তার সান্নিধ্যে নেওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মহানবির নুবয়তি দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়াও তার কুদরতের নিদর্শনসমূহ অবলোকন করে একান্ত সাক্ষাত করার জন্য। এ পবিত্র রজনীতে প্রিয় হাবীবের একান্ত সাক্ষাতে যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছিল তা আমরা আল কুরআনের মাধ্যমে জানতে পারি। সে সিদ্ধান্তগুলো হলো: (১) আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত করা যাবে না। (২) পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে হবে। (৩) মিসকিনদের ও পথশিশুদের অধিকার দিতে হবে। (৪) অপচয় করা যাবে না, অপচয়কারী শয়তানের ভাই। (৫) কার্পণ্য বা কৃপণতা করা যাবে না। (৬) সন্তান হত্যা করা যাবে না। (৭) এতিমের সন্তান আত্মসাৎ করা যাবে না। (৮) প্রতিশ্র“তি পূর্ণ করতে হবে। (৮) মাপে পূর্ণ দিতে হবে। (৯) অজ্ঞতার সাথে কোনো কিছু করা যাবে না। (১০) এ সবই মন্দ যা তোমার রবের কাছে অপছন্দ। সুরা ইসরা, আয়াত (২২Ñ৪৪)।
পরিশেষে বলতে পারি, বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটে আমরা যদি মেরাজের শিক্ষাগুলো বুঝতে পারতাম এবং সে মোতাবেক সমাজ গঠন করতে পারতাম তাহলে অবশ্যই সত্যিকার মনুষ্যত্বের মর্যাদা সহকারে পৃথিবীতে বসবাস করতে পারবে। মিরাজে মহানবি (স) বিশ্ববাসীর জন্য নামাজকে উদাহরণ স্বরূপ নিয়ে আসেন। তাই নামাজ হলো মুমিনদের মিরাজ।লেখক: শিক্ষাবিদ, গবেষক, প্রাবন্ধিক।

 

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply