২৪ এপ্রিল ২০২৪ / ১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / দুপুর ২:১৯/ বুধবার
এপ্রিল ২৪, ২০২৪ ২:১৯ অপরাহ্ণ

‘বাংলাদেশে ব্যারিস্টার একটি উপাধি ছাড়া কিছুই না’

     

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। একই সঙ্গে তিনি রাজনীতিতেও সমান সক্রিয়। বর্তমানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। চট্টগ্রামের প্রাণ পুরুষ খ্যাত, সাবেক সিটি মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী হলেন তার বাবা।

সম্প্রতি আইন, আদালত, রাজনীতি প্রসঙ্গে কথা হয় আইনজীবী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল’এর সাথে। আলোচনায় উঠে আসে নানান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-

আইনজীবী হবার ইচ্ছে কি আপনার না অভিভাবকের ছিল?

ব্যারিস্টার নওফেল : ফিজিক্সে (physics) দারুন ইন্টারেস্ট ছিল বলে নিজের ইচ্ছে ছিল অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হব। কিন্তু পরিবারের চাওয়া ছিল আইনজীবী হতে হবে। সে অনুযায়ী ব্যারিস্টারি পড়েছি। এ লেভেল শেষ করে লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স থেকে আইন ও নৃবিজ্ঞানের ওপর বিএ সম্পন্ন করি। এরপর বার কোয়ালিফিকেশন হিসেবে পরিচিত বার কোর্স করি। কলেজ অব ল’ (বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব ল’) থেকে আইনের ওপর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা করি। এরপর লিংকনস ইন – এর সদস্য হবার জন্য ডাক আসে।

আমাদের দেশে অ্যাডভোকেট এবং ব্যারিস্টারের মধ্যে তফাৎ নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে একটি দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। অনেকে ভাবেন ব্যারিস্টাররা সম্ভবত অ্যাডভোকেটদের চেয়ে ভাল উকিল! – এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

ব্যারিস্টার নওফেল : ব্যারিস্টাররা অ্যাডভোকেটদের চেয়ে ভাল উকিল এমন ধারণা ভুল। এটা সম্পূর্ণ একটা মিস কনসেপ্ট। পুরো বিষয়টা একটু পরিষ্কার করে বলি। যুক্তরাজ্য (united kingdom) চারটা রাজ্যে বিভক্ত। ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড এবং নর্দান আয়ারল্যান্ড। এরমধ্যে ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে আইন পেশা দুই ভাগে বিভক্ত, সলিসিটর এবং ব্যারিস্টার। যারা কোর্টে প্র্যাকটিস করবে, রেটিগেশন করবে তথা কোর্ট বিষয়ক পরামর্শ দেবে তারা ব্যারিস্টার। অন্যদিকে যারা কোর্ট ব্যতীত অন্যান্য যাবতীয় আইনি বিষয়ে পরামর্শ দেবে তারা সলিসিটর। তবে দু’জনই যোগ্যতায় সমানে সমান। এখন ব্যারিস্টারি পড়ে কি শেখা যায় সে বিষয়ে একটু বলি, ব্যারিস্টারি আসলে করা হয় ইংল্যান্ডের আদালতে প্র্যাকটিস করার জন্য। এখানে সে দেশের ফৌজদারি ও দেওয়ানী কার্যবিধি, সাক্ষ্য আইন এবং আদালতের যে কার্যবিধি সেসব বিষয় জানা যায়। এর সঙ্গে বাংলাদেশে প্র্যাকটিসের সঙ্গে মিল নেই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যারিস্টার একটা সামাজিক উপাধি ছাড়া কিছুই না। যেমন হজ্ব করে এসে অনেকেই আলহাজ্ব লিখেন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যারিস্টারও শ্রেফ তেমন একটা সামাজিক উপাধি। আমি মনে করি গণসচেতনতার অভাবে সাধারণ মানুষের মনে একটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে যে ব্যারিস্টাররা সম্ভবত অ্যাডভোকেটদের চেয়ে ভাল উকিল! যে ভাল উকিল সে ব্যারিস্টার হোক বা না হোক সে ভাল উকিল। আরেকটা বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের আইনি কাঠামোতে প্র্যাকটিস করতে হলে ব্যারিস্টার হলেও অ্যাডভোকেটশীপ নিতে হবে। আমাদের আইন পেশায় একটাই উপাধি, আর তা হল অ্যাডভোকেট। আমাদের দেশের আইনে কেবল অ্যাডভোকেটরাই কোর্ট অফিসার।

তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যারিস্টার হয়ে আসলেই ভাল আইনজীবী ভাবার সুযোগ নেই?

ব্যারিস্টার নওফেল : অবশ্যই, কারণ ইংল্যান্ডের দেওয়ানী ও ফৌজদারি কার্যবিধি শিখে বাংলাদেশের আদালতে কিভাবে প্র্যাকটিস করবেন? বাংলাদেশে প্র্যাকটিস করতে হলে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের তালিকাভুক্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অ্যাডভোকেট হতে হবে। বাংলাদেশের ফৌজদারি ও দেওয়ানী কার্যবিধি, সাক্ষ্য আইন ইত্যাদি শিখতে হবে। আমি আইন শিক্ষার্থীদেরও বলবো এ বিষয়ে সচেতন হতে। ইংল্যান্ডে গিয়ে পয়সা খরচ করে ব্যারিস্টারি পড়ে এসে লাভ নেই। অনেকেই অজ্ঞতা প্রসূত এই ভুলটি করে থাকেন। আমি মনে করি ইংল্যান্ডে গিয়ে ব্যারিস্টারি না পড়ে সাবস্ট্যান্টিভ (substantive) আইন পড়া অনেক বেশি উপকারী হবে। বিশেষ করে এল.এল.এম করা শ্রেয়। কেননা একটা আন্তর্জাতিক কর্মাশিয়াল বিষয়ের ওপর এলএলএম করলে বরং প্রায়োগিক কিছু শেখা যাবে।

এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসা যাক। আপনি তো সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, উচ্চ আদালতের রায় বাংলায় দেওয়া উচিৎ বলে আপনি মনে করেন কি?

ব্যারিস্টার নওফেল : একটা উদাহরণ দিয়ে বলি, ১৯৯৬ সালে ইংল্যান্ডের আইনি কাঠামোতে সংস্কার আসে। এসময় পুরো লিগ্যাল সিস্টেমে ব্যাপক পরিবর্তন করে আধুনিকায়ন করা হয়।  ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি লর্ড উল্ফ বলেন, যে ভাষা জনগণ বোঝে না সে ভাষায় বিচারকার্য পরিচালনা জনগণের প্রতি অবিচার। পরে বিচারপ্রার্থী সাধারণ মানুষের বোধগম্য করার জন্য ইংলিশ ল’ তে প্রচলিত সকল ল্যাটিন শব্দ বাদ দেওয়া হয়।

অথচ আমরা এখনো ঔপনিবেশিক ধ্যান ধারণা নিয়ে পড়ে আছি। যদিও আমরা নিজেদের ব্রিটিশ কমন ল’ এর অনুসারী দাবি করে থাকি। পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নাই যেখানে শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষ এক ভাষায় কথা বলে আর উচ্চ আদালত চলে অন্য ভাষায়! এটা তো অবিচার। মানুষ যদি না-ই বুঝে আদালত কি রায় দিয়েছে তাহলে সে কিভাবে বুঝবে যে সে ন্যায় বিচার পেয়েছে? জনগণ যদি কোর্ট ফি দিয়ে নিজ ভাষায় রায় না পায় তাহলে সেটা জনগণের প্রতি অবিচার। জনগণের প্রতি সুবিচার করতে সাধারণ মানুষের ভাষায় (বাংলা) আদালতের রায় আনা জরুরী। এছাড়া উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হতে ঢাকাতেই কেন আসতে হবে? অন্তত দেশের বিভাগীয় শহরে উচ্চ আদালতের সার্কিট বেঞ্চ স্থাপন করে বিচারব্যবস্থাকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে হবে।

সম্প্রতি ভারতের কেরালা রাজ্য সরকার শিক্ষানবীশ আইনজীবীদের মাসিক ভাতা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে; আপনি তো কিছুদিন আইনে শিক্ষকতাও করেছেন, জুনিয়র আইনজীবী হিসেবে সময় পার করে এসেছেন, আমাদের দেশে এ প্রথা চালু করার প্রয়োজনীয়তা কেমন মনে করেন?

ব্যারিস্টার নওফেল : আইনের ডিগ্রি নিয়ে প্রফেশনাল লাইফের প্রথম ধাপে বেশীরভাগ সময় আদালতে এসে শিক্ষানবীশ আইনজীবীরা আর্থিক সঙ্গতির অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়। আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবিক জ্ঞান অর্জনের এই সময়টাতে জীবনের তাদের অনেক সংগ্রাম করতে হয়। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল যদি শিক্ষানবীশ আইনজীবীদের জন্য মাসিক ভাতা চালু করে সেটা তাদের বেশ সহায়ক হবে। এছাড়া এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে ইংল্যান্ডের মত আমাদের দেশেও দ্বিস্তর বিশিষ্ট আইন পেশার কাঠামো থাকা জরুরী। অর্থাৎ একটি হবে আদালত ভিত্তিক আইন পেশা এবং অন্যটি পরামর্শ ভিত্তিক আইন পেশা। আইন পেশায় এই সংস্কার যদি আনা হয় তাহলে পরামর্শ ভিত্তিক আইন পেশায় জড়িতরা চট করেই সমস্যাটিকে মামলায় রূপান্তরিত করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসবে। ফলে আমাদের পাহাড় সমান মামলার জটে নতুন মামলা যুক্ত হবার সম্ভাবনা কমে যাবে। কিন্তু আমাদের দেশে কেউ পরামর্শ নিতে চাননা। আইনজীবীদের সার্ভিসটা কেবল মামলা ভিত্তিক। যে কারণে যেকোনো সমস্যাই দ্বন্দ্বে বা মামলায় রূপান্তরিত করার প্রবণতা বেশি। কেননা মামলা ছাড়া আইনজীবী অচল। মামলার মেরিট থাকুক বা না থাকুক মামলা না হলে তো মক্কেল পয়সা দেবে না। অন্যদিকে যদি দ্বিস্তর বিশিষ্ট আইন পেশা হয় তাহলে এক স্তরে পরামর্শক তথা সলিসিটর হিসেবে কেউ থাকবেন, যারা সমস্যার আদ্যোপান্ত জেনে কি করণীয় সে বিষয়ে পরামর্শ দেবেন। অন্যদিকে যে সকল সমস্যায় মামলা করার মত মেরিট থাকবে সেগুলো আদালত ভিত্তিক আইন পেশায় জড়িত অ্যাডভোকেটরা মামলা পরিচালনা করবেন। আর এই দ্বিস্তর বিশিষ্ট আইন পেশার কাঠামো বাস্তবায়নে আইন মন্ত্রণালয়, বার কাউন্সিল এবং আইনজীবী নেতাদের উদ্যোগ নিতে হবে।

আপনি তো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, আইনজীবীদের রাজনৈতিক সম্পৃকতা বেশী জরুরী মনে করেন কি?

ব্যারিস্টার নওফেল : আইনজীবীদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন বয়ে আনে। এক সময় আইনজীবীরাই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মূলত অধিকার নিয়ে সংগ্রাম এবং নীতি প্রণয়নের সমন্বয় হচ্ছে রাজনীতি। ফলে অধিকার বাস্তবায়ন ও নীতি প্রণয়নে আইনজীবী সর্বদা অগ্রগণ্য। তবে এর মানে এই নয় যে আইনজীবীরাও কেবল রাজনীতি করার অধিকার রাখে। যোগ্য যেকোন ব্যক্তিই রাজনীতি করতে পারেন। তবে রাজনীতিতে আইনজীবীদের সক্রিয় উপস্থিতি রাজনীতির মানোন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। পৃথিবীর বেশীরভাগ উন্নত দেশেই আইনজীবীরা রাজনীতিতে বেশ সক্রিয়। আইনজীবীরা স্বাধীন পেশার মানুষ। ফলে তারা কোন স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট নন । আর পেশাগত স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা বা স্বার্থ সংঘাত না থাকলেই জনস্বার্থে সবচেয়ে বেশি কাজ করা যায়। স্বাধীন পেশার মানুষ হওয়ায় আইনজীবীরা স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে সার্বজনীন হতে পারেন। আরেকটা বিষয় হচ্ছে টেকনিক্যাল। পার্লামেন্টে আইন প্রণয়ন ও ড্রাফটিংসহ প্রণীত আইন অন্য আইনের সাথে সাংঘর্ষিক কি-না সেগুলো যাচাই-বাছাইয়ে আইনজীবী সংসদ সদস্য হওয়া জরুরী।

ধন্যবাদ আপনাকে।

ব্যারিস্টার নওফেল : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
সূত্র: ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডট কম

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply