২৫ এপ্রিল ২০২৪ / ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / দুপুর ১২:২৭/ বৃহস্পতিবার
এপ্রিল ২৫, ২০২৪ ১২:২৭ অপরাহ্ণ

মানবপ্রেম ও ঐশ্বরিক সান্নিধ্যই সুফিবাদ

     

ডাঃ বরুণ কুমার আচার্য 

সভ্যতার উন্মেষলগ্ন থেকেই মানুষের এক্সটারনাল বা বাহ্যিকজ্ঞান বিকাশ লাভ করেছিল। তারই পাশাপাশি অতি স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মরমী চেতনারও বিকাশ হয়েছিল। তার কারণ মানুষ চিরদিনই অজানা অদৃশ্যগুলো সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করতে চেয়েছে। দৃশ্যের অপারের দৃশ্য দেখার নেশা মানুষের বরাবরের। অজানা অনন্তকে জানার এই যে অনন্ত প্রয়াস এটি মানুষের এক স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। বিভিন্ন সময়ে তাসাউফ বনাম সুফিবাদের বিষয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা এসেছে। তথ্যমতে ঐতিহাসিকভাবে মুসলমানরা সুফিদের আধ্যাত্মিক সাধনাকে প্রকাশ করার জন্য তাসাউফ শব্দটি ব্যবহার করত। মানুষের জীবন আত্মা ও দেহের সমন্বয়ে গঠিত। সুফিবাদের যে জ্ঞানের সাহায্যে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা হয় তাকে বলা হয় এলমে তাসাউফ। সুফিবাদ বা সুফিদর্শন একটি আধ্যাত্মিক দর্শন। আত্মা সম্পর্কিত আলোচনা এর মুখ্য বিষয়। আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্ল¬াহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনই হলো এই দর্শনের মর্মকথা। পরমসত্তা মহান আল্লাহকে জানার এবং আকাক্সক্ষা মানুষের চিরন্তন। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কে আধ্যাত্মিক ধ্যান ও জ্ঞানের মাধ্যমে জানার প্রচেষ্টাকে সুফিদর্শন বা সুফিবাদ বলা হয়। আসলে সুফি মতবাদ হল মানুষের স্বাভাবিক চিন্তাধারা ও মরমী জ্ঞানের স্ফুরণ স্বরূপ। ঐতিহাসিক সুফিদের মতে তাসাউফ ইসলামের একটি বিশেষরূপ যা ইসলামিক শরীয়াহ আইন এর অনুরূপ। তাঁদের মতে, বিশ্বের সকল প্রকার মন্দ এবং গর্হিত কাজ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য শরীয়াহ এই বিশ্বকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। তাঁরা মনে করেন, তাসাউফ ইসলামের অবিচ্ছেদ্য এবং ইসলামিক বিশ্বাস এবং অনুশীলনের অপরিহার্য অংশ। কার্ল এর্নহর্ট এর মতে, সুফিবাদ শব্দটি কোনো ইসলামিক গ্রন্থ বা কোনো সুফিদের কাছ থেকে আসেনি। তাঁর মতে, শব্দটি এসেছে প্রাচ্যের ভাষা বিষয়ক ব্রিটিশ গবেষকদের থেকে। ইসলামিক সভ্যতায় (ইসলামিক আধ্যাত্মিকতা) তাঁরা যে মনোমুগ্ধকর বিষয় উপলব্ধি করেন এবং তৎকালীন যুক্তরাজ্য ইসলাম সম্বন্ধে নেতিবাচক ধারণা বা বিশ্বাস বিরাজ করছিল তার মধ্যে কৃত্রিম পার্থক্য সৃষ্টি করতে তারা সুফিবাদ শব্দটি ব্যবহার করেন।
মানব সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন সভ্যতায় সাধক পুরুষদের আবির্ভাব ঘটেছে। বিশ্বের সকল সাধু ও সুফিদের লক্ষ্য অভিন্ন। অজানার সন্ধানে ছুটে চলা, অজ্ঞাতরে বোধের সীমানায় নিয়ে আসা। ইতিহাস অনুসন্ধানে জানাযায়, ১২০৪-৫ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খলজি কর্তৃক বাংলাদেশ বিজিত হলে ইসলামের শরিয়ত ও মারফত উভয় বিষয়ে প্রচার প্রসার তীব্রতর হয়। শাসক শ্রেণির সঙ্গে বহু পীর-দরবেশ এদেশে আগমন করে ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। এ সকল পীর দরবেশগণ সুফিবাদের আধ্যাত্মিক তত্ত্ব চমৎকারভাবে তুলে ধরে সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেন।
পক্ষান্তরে সুফিগণ কর্ম কোলাহলমুখর কর্মমুখী জীবন পরিত্যাগ করে মরমী-নির্জন জীবনে অত্যধিক ঝুকে পড়েছিলেন। কেননা সুফিদের মরমী সাধনা ছিল একান্তই ব্যক্তিগত। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় একজন সুফিসাধক নিজের আত্মার পরিশুদ্ধি ও নির্জন ধ্যানমগ্নতায় নিমজ্জিত থাকবেন না। বরং তিনি সমাজের মানুষের সেবামূলক মানসিকতা জাগরিত করে এ শিক্ষাই দেবেন যে, পৃথিবী একটি সেবা ও দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্র, শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ভোগের নয়।
কালক্রমে সুফিবাদে সর্বেশ্বরবাদ ধারণা যুক্ত হতে থাকে। এ ধরনের মতবাদের মূল প্রবক্তা বায়েজিদ বোস্তামী ও মনসুর হাল্লাজ। অতপর ইমাম গাজ্জালীর সময় থেকে সুন্নিবাদী মতবাদ সুফিবাদের ভিতরে একটি বিশেষ স্থান দখল করে নেয়। তিনি গোঁড়া ইসলাম ও সুফিবাদের মধ্যে সুন্দর সমন্বয় করেন। ভারতীয় উপমহাদেশে অনেক সুফির আবির্ভাব ঘটে, যাঁদের মধ্যে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী, মুজাদ্দেদ আলাফসানী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বস্তুতপক্ষে সুফিবাদ উৎকর্ষ লাভ করে পারস্যে। সেখানকার প্রখ্যাত সুফি-দরবেশ, কবি-সাহিত্যিক এবং দার্শনিকগণ নানা শাস্ত্র, কাব্য ও ব্যাখ্যা-পুস্তক রচনা করে এই দর্শনকে সাধারণের নিকট জনপ্রিয় করে তুলেন। কালক্রমে বিখ্যাত ওলীদের অবলম্বন করে নানা ত্বরিকা গড়ে উঠে।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত অধ্যাত্ম সাধক ও বাংলাদেশে প্রবর্তিত একমাত্র ত্বরিকা, ত্বরিকা-ই-মাইজভাণ্ডারীর প্রবর্তক গাউসুল আযম হযরত মাওলানা শাহসুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (ক.)। গাউছুল আযম হযরত আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী প্রতিষ্ঠিত মাইজভাণ্ডারী ত্বরিকা। এই ত্বরিকায় সুফি দর্শনের ব্যাপকতা রয়েছে। কেননা সুফিবাদের মাধ্যমেই সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব। সুফিদর্শন হলো মানুষকে ভালোবাসত। কারণ মানবপ্রেম ধর্মের মর্মবাণী। এজন্য আগে নিজেকে শুদ্ধ হতে হবে। এছাড়াও গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর মতো মহান পুরুষদের নির্দেশিত পথে চললে সমাজে সুন্দর কিছু উপহার দেয়া সম্ভব।
এরই ধারাবাহিকতায় সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী ছিলেন মাইজভাণ্ডারী ত্বরিকার একজন প্রখ্যাত সুফি সাধক। তিনি বিশ্বঅলি, শাহেনশাহ, জিয়াবাবা এবং শাহেনশাহ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী কাদ্দাছা ছিরহুল আজিজ নামে পরিচিত।
তিনি ১০ পৌষ ১৩৩৫ বঙ্গাব্দ, ২৫ ডিসেম্বর ১৯২৮ খৃ. ১২ রজব ১৩৪৭ হিজরি মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফে জন্মগ্রহণ করেন। জানা যায়, সুফিতাত্ত্বিক সাধনা কালে নিরবিচ্ছিন্নভাবে তিনি দিনের পর দিন আহারে নিঘুম অবস্থায় কাটিতে দিতেন। কখনো তীব্র শীতে পুকুরের কনকনে ঠাণ্ডা জলে দিনরাত একাধারে ডুবে থাকতেন। আবার কখনো জৈবনিক ক্রিয়াকলাপমুক্ত থেকে ঘরের দরজা বন্ধ অবস্থায় আপাদমস্তক চাদরমুড়ি দিয়ে কাটিয়ে দিতেন দিনের পর দিন।
তাঁর বহুল আলোচিত রহস্যময় অলৌকিক ঘটনাবহুল জীবন চিরস্মরণীয়।
সুফিগণ ইসলামের মহাসত্যর প্রতি মানুষকে আহবান করেছেন প্রেমের মাধ্যমে। মানবপ্রেম তথা সৃষ্টির প্রতি প্রেমের মাধ্যমে স্রষ্টার প্রেমার্জন ছিল সুফিবাদের মূল আদর্শ। সুফিগণ নিজেদের আদর্শ জীবন এবং সুফিবাদের প্রেম-ভ্রাতৃত্ব-সাম্যর মধুরবাণী প্রচার করে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এদেশের সাধারণ মানুষের মনজয় করতে সক্ষম হয়েছেন। অসাম্প্রদায়িক ঐক্যের মূর্ত প্রতীক মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফ যাতে সন্নিবেশিত আছে অসাম্প্রদায়িক ঐক্য এবং ইহ ও পারলৌকিক মুক্তির পন্থা। যাহা গাউসুল আযম শাহসুফি হযরত মাওলানা সৈয়দ আহমদ উল¬াহ মাইজভাণ্ডারী (ক.) নির্দেশিত ত্বরিকা। এটি উপমহাদেশের প্রধান আধ্যাত্মিক চর্চার প্রাণকেন্দ্র। এটি কেবল একটি দর্শন নয়। পারলৌকিক সাধনা কিংবা চেতনার নাম এবং একটি মানবতাবাদ। অসাম্প্রদায়িক এবং বিচার সাম্যমূলক সমাজ বিনির্মাণের সংগ্রাম। এ দর্শন সর্বধরনের গোঁড়ামি ও মানবতাবিরোধী অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে একটি সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক বিপ¬ব। একজন মানুষ মৃত্যু পর্যন্ত মাইজভাণ্ডারী তরিকতের উপর জীবন পরিচালনার মধ্যে আছে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তি। মানুষের প্রতি সহমর্মিতা, প্রেম, বিনয় সুলভ ভাব ও বিপদগ্রস্থে পাশে দাঁড়ানো মাইজভাণ্ডারী দর্শনের মর্মকথা। যাহা এখনো বহাল রয়েছে এবং এই অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছার জন্য অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছেন মাইজভাণ্ডার শরীফ গাউছিয়া হক মঞ্জিলের সাজ্জাদানশীন আলহাজ্ব সৈয়দ মোহাম্মদ হাসান মাইজভান্ডারী। মাইজভান্ডারী গাউসিয়া হক কমিটি বাংলাদেশ, হযরত জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী ট্রাস্ট, মাইজভান্ডারী একাডেমী, মাইজভান্ডারী মরমী গোষ্ঠী, মাইজভান্ডারী গাউছিয়া হক কমিটি সূর্যগিরি আশ্রম শাখা। এই সংগঠনটি দেশব্যাপী বিভিন্ন শাখার মানবতার কল্যানে সকল কর্ম নিরলসভাবে করে যাচ্ছেন। পরিশেষে মানবমুক্তির পথ প্রদর্শনের জন্য সুফিবাদে বিশ্বাসী হতে পারলেই জাগতিক সুখ যেমনি সম্ভব তেমনি ঐশ্বরিক সান্নিধ্য পৌঁছানো সহজ হবে।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply