১৮ এপ্রিল ২০২৪ / ৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / সকাল ৮:১৬/ বৃহস্পতিবার
এপ্রিল ১৮, ২০২৪ ৮:১৬ পূর্বাহ্ণ

অনিবন্ধিত ওষুধ বিক্রয়কেন্দ্র, জনস্বাস্থ্য ঝুঁকিতে

     

মাহমুদুল হক আনসারী

স্বাস্থ্য সুখের মূল। সব কিছুর উপর মানুষের স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য ভালো যার তার সব কিছুই ভালো। মানুষের রোগের কোনো সীমা নেই। নিত্যনতুন রোগের তৈরী হচ্ছে মানব জীবনে। বাজারে নানা প্রকারের ওষুধ কোম্পানী সৃষ্টি হচ্ছে। ওষুধ তৈরী বাজারজাত ও বিক্রয় সব কিছুতেই সংষ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়পত্র নেয়ার বিধান আছে। ওষুধের অপর নাম বিষ। বিষ খেলে মৃত্যু হয়। আবার রোগের নিরাময়ের জন্য চিকিৎসকের প্রেসক্রিপসনে এ ওষুধ নামক বিষ খেয়ে নিরাময় নিতে হয় রোগীদের। ওষুধেও নানা ভেজাল। নিম্ন মানের ওষুধ ও কোম্পানীতে বাজার সয়লাব । ওষুধ কোম্পানীর এম আরদের দৌরাত্মে রোগীতো আছে, স্বয়ং ডাক্তারও বিবৃতকর অবস্থায় পড়ে। বাংলাদেশে প্রতিদিন ওষুধ নামক মেডিসিন কোম্পানীর জন্ম হচ্ছে। সংষ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে কেউ কেউ অনুমতি নিচ্ছে কেউ অনুমতি ছাড়া ভেজাল ও দুই নম্বারী পথে ওষুধ নামক বিষ আবিষ্কার করছে। আবার তা তাদের রিপ্রেজেন্টেটিভদের দিয়ে নিবন্ধিত অনিবন্ধিত ওষুধের দোকানে বিক্রি করছে। এ ওষুধের দামও বেশী হয়। প্যাকেট ও কাভার খুবই চাকচিক্য। যত্রতত্র গড়ে উঠা এসব আনাড়ী মার্কা দোকান ও বিক্রয় কেন্দ্র নানা ধরনের রোগীদের এ সব ওষুধ খাওয়াচ্ছে। দিন মজুর খেটে খাওয়া মানুষ তাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে তেমনভাবে সচেতন না হওয়ার সুযোগে ওই সব ওষুধ কেন্দ্র হতে ওদের কথায় ওষুধ সেবন করে থাকে। গলাকাটা মূল্যে ‍দিয়ে কিনা হয় এ সব ওষুধ। ওষুধ নামক এ বিষ খেয়ে ধিরে ধিরে অসংখ্য রোগী রোগের মুক্তি পাওয়ার পূর্বে নতুন নতুন জঠিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। শহর থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ওষুধ বিক্রয় কেন্দ্র কূী পরিমাণ রয়েছে তার হিসাব সাধারণ মানুষের কাছে থাকা দূরে থাক, খোদ সরকারের সংষ্লিষ্টদের আছে বলে মনে হয়না। তবে ওই ওষুধ বিক্রয় কেন্দ্রে নিত্য প্রয়োজনীয় থেকে শুরু করে দুরারোগ্য রোগের ওষুধও দেদারসে পাওয়া যায়। স্বাস্থ্যগত সংবেদনশীলতা বিবেচনায় এসব ওষুধ বিক্রয় কেন্দ্রে পরিচালিত হচ্ছে অদক্ষ হাতে। যেখানে সেখানে গড়ে উঠা বিক্রয় কেন্দ্রগুলোর নিবন্ধনও নেই ঠিকমতো। গতবছরের শেষপ্রন্তে পরিচালিত এক সমীক্ষা অনুযায়ী, বর্তমান দেশের ৫০ শতাংশ ওষুধ বিক্রয় কেন্দ্রই অনিবন্ধিত। নিবন্ধিত না হওয়াই এসব কেন্দ্র পরিচালনার দক্ষতা যাচাইয়েরও বালাই নেই। ফলে এগুলোর মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স ফর হেলথ ‘ এর অর্থায়নে এবং যুক্তরাষ্টভিত্তিক দাতা সংস্থা ইউএসএআইডি, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সিস্টেমস ফর ইমপ্রুভড্ অ্যাকসেস টু ফার্মাসিউটিক্যালস অ্যান্ড সার্ভিসেস (এস আই এ পি এস), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্র্যান্ট ফর পাবলিক হেলথ এর সহযোগিতায় পরিচালিত বেজলাইন স্টাডি অব প্রাইভেট ড্রাগ শফস ইন বাংলাদেশ শীর্ষক এক সমিক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রের বরাত দিয়ে খবরটিতে আরও বলা হয় দেশে মোট নিবন্ধিত খুচরা ওষুধ বিক্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা ১ লাখ ৫ হাজার ১৬৬ টি। সমীক্ষা চলাকালে বাংলাদেশে মোট নিবন্ধিত খুচরা ওষুধ বিক্রয় কেন্দ্র ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ৫৪১ টি। সমীক্ষার হিসাব অনুযায়ী প্রায় সমপরিমাণই রয়েছে অনিবন্ধিত ওষুধ বিক্রয় কেন্দ্র। সমীক্ষা চলাকালে দেশে শুধু ওষুধ বিক্রয় কেন্দ্র ছিল ২ লাখ ৬ হাজার ৯০২ টি। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ অনিবন্ধিত। সমীক্ষায় দেশের বিক্রয় কেন্দ্রগুলোর বৈধতা ও কর্মী দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য নমুনা হিসেবে শহর গ্রামঞ্চলের মোট ১১১টি ওষুধ বিক্রয় কেন্দ্র পর্যালোচনা করা হয়। এতে দেখা যায় এগুলোর মধ্যে ৮০ শতাংশ ওষুধ বিক্রয় কেন্দ্রের ড্রাগ লাইসেন্স আছে যার ৬৯ শতাংশ বিক্রয়কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে একজন ডিসপেন্সর দিয়ে। এসব ডিসপেন্সারের আবার ৪১ শতাংশেরই কোন প্রশিক্ষণ নেই। আইন অনুযায়ী ওষুধ বিক্রয় কেন্দ্রে অন্তত একজন সি গ্রেডের প্রশিক্ষণ সনদপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট থাকতে হবে। আবার প্রশিক্ষিত ফার্মাসিস্ট আছে এমন বিক্রয় কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ‘সি’ গ্রেডের অর্থাৎ প্রশিক্ষণ সনদপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট আছে ৯ শতাংশ, ‘বি’ গ্রেডের অর্থাৎ যাদের ডিপ্লোমাপ্রাপ্ত রয়েছে ৭ শতাংশ আর স্নাতক বা ‘এ’ গ্রেডের ফার্মসিস্ট আছে মাত্র ২ শতাংশ বিক্রয় কেন্দ্রে। সমীক্ষায় আরো দেখা গেছে ওষুধ বিক্রয় কেন্দ্রে আসা ৬৮ শতাংশ গ্রাহক আসে কোন চিকিৎসকেরে পরামর্শ ছাড়া। আর ৮৩ শতাংশের ক্ষেত্রে গ্রাহক বা রোগীকে ওষুধের পরামর্শ দেন ওষুধ বিক্রয় কেন্দ্রে কর্মরতরা। ওষুধ বিক্রি ছাড়াও কেন্দ্রগুলো অন্য সেবাও দিয়ে থাকে। দেখা গেছে ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে ওষুধ বিক্রয় কেন্দ্রেগুলোয় ইনজেকশান দেওয়া হয়। কোন প্রকার ড্রাগ লাইসেন্স ছাড়াই এ ধরনের সেবা দিয়ে থাকে এরা। দেখা গেছে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে যেখানে সেখানে অপরিকল্পিতভাবেই ফার্মেসী গড়ে উঠছে। এভাবেই যদি ওষুধ বেচা বিক্রি চলে তাহলে দেশের স্বাস্থ্যসেবা বলতে কি কিছু থাকবে কিনা সন্দেহ। এভাবেই যদি মানুষ ওষুধ সেবন করেন তা হলে রোগ নিরাময় হওয়া দূরের কথা, রোগ আরও গাঢ় হয়ে মৃত্যুর পথযাত্রী হতে হবে মানুষকে। এরকম দেশের মানুষের স্বাস্থ্যহানির প্রক্রিয়া বন্ধ করা দরকার। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিবন্ধনহীন ও অদক্ষ ফার্মাসিস্ট দ্বারা পরিচালিত বিক্রয় কেন্দ্রে ওষুধের মতো স্পর্শকাতর পণ্যের অবাধ বেচাকেনার পাশাপাশি জঠিল রোগের চিকিৎসাও করা হচ্ছে। ফলে অপচিকিৎসার শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের লাখ লাখ মানুষ। এদ্বারা চলতে দিলে দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাই বিপর্যস্ত হবে। তাই যত দ্রুত সম্ভব সব ফার্মেসিকে নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসা সরকারের অন্যতম অবশ্যপালনীয় দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। তাছাড়া প্রত্যেক ফার্মেসিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন ফার্মাসিস্ট যাতে থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে যারা বিক্রয়কর্মী রয়েছে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাও দরকার। আইনের যতাযত প্রয়োগে কোনো প্রকার শিথিলতা কাম্য নয়। এক্ষেত্রে কঠোর হতেই হবে। আমাদের প্রত্যাশা স্বাস্থমস্ত্রণালয় স্বাস্থঝুঁকির বিষয়টি জরুরি বিবেচনা করে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহন করতে আর দেরি করবে না। আসুন সম্মিলিতভাবে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় এগিয়ে আসি।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply