২০ এপ্রিল ২০২৪ / ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / দুপুর ১:৩৯/ শনিবার
এপ্রিল ২০, ২০২৪ ১:৩৯ অপরাহ্ণ

কাঞ্চননগর ও দোহাজারী রেলসড়কের উভয় পাশে ডিজিটাল হাইটেক পার্ক ও শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা হলে দক্ষিণ চট্টগ্রাম হবে অন্যতম অর্থনৈতিক জোন

     

কামরুল হুদা
সার্বভৌম দেশের নাগরিকদের বাসস্থান থাকা একটি মৌলিক অধিকার বলে বর্তমান সভ্যতায় স্বীকৃত সত্য। বাংলাদেশে অধিকাংশ নগরবাসীর জন্য চট্টগ্রাম মহানগরে একটি নিজস্ব একখন্ড জমি বা একটি ফ্ল্যাট প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। একখন্ড জমি ও ফ্ল্যাটের মূল্য এত বেশি যে তা ক্রয় করা অনেকের জন্যই অসম্ভব।
গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের দায়িত্ব তার নাগরিকদের বাসস্থনের অধিকার ও স্বপ্ন পূরণে সহায়তা করা। বাংলাদেশ অধিক জনসংখ্যার ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। এখানে ভূমির স্বল্পতা সমস্যা প্রকট। লোকদের খাবারের জন্য কৃষি ভূমির প্রয়োজন। এ সব বিষয় বিবেচনায় রেখে চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলায় কাঞ্চননগর-দোহাজারী রেলসড়কের দুপাশে শিল্পাঞ্চল ও শহর গড়ে তোলা প্রয়োজন। কাঞ্চননগর-দোহাজারী রেলসড়কের উভয় পাশের ভূমিই পাহাড়ী অঞ্চল। যেহেতু আনোয়ারা শিল্প জোনের মত সরকারের কাছে দাবি তুলতে পারি দোহাজারী সাংগু নদীর পাশ ও হাশিমপুর-কাঞ্চনাবাদ ইউনিয়নে কাঞ্চননগরে হাজার হাজার একর সরকারের খাস জমি ও রেলের খালি জায়গায় পরিকল্পিত ডিজিটাল হাইটেক পার্ক ও শিল্প জোন করে এলাকার বেকার সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে।
কাঞ্চননগর-দোহাজারী শিল্পাঞ্চলের বিবেচনায় আনা হলে কয়েক লাখ বেকার লোকের কর্মসংস্থান করে চট্টগ্রাম মহানগরের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ হ্রাস করতে পারে এবং শিল্পনগরী স্থাপন করে বিভিন্ন শিল্প স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। আর অন্যদিকে দোহাজারীর সাঙ্গু নদীর পার্শ¦বর্তী ভূমিতে শিল্পনগরী হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে এবং মহাসড়কের অপর পাশে বাসস্থানের শহর হিসেবেও গড়া যাবে। এতে বর্তমান সড়কটি চট্টগ্রাম থেকে প্রস্তাবিত শিল্প ও বাসস্থান শহরে যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করা যাবে।
সরকারের বাসস্থান পরিদপ্তরকে বাসস্থান শহর এবং বাংলাদেশ শিল্প কর্পোরেশনকে শিল্পনগরী স্থাপনের দায়িত্ব দেয়া প্রয়োজন। বাসস্থান শহরের প্লটসমূহ তিন শ্রেণির লোকদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি লিজ দেয়া দরকার- (১) শহর/নগরী গড়ে তুলতে যাদের ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে তারা (২) চট্টগ্রাম মহানগরে দেশের উন্নয়ন কর্মে যাদের ভূমি অধিগ্রহণ করা হয় তাদের এবং (৩) সাধারণ জনগণ। জমি লিজ দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো কোটা যেমন, বিচারক কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা, এমপি কোটা, সরকারি কর্মকর্তা কোটা, স্বায়ত্তশাসিত কর্মকর্তা কোটা, অনাবাসিক বাংলাদেশি কোটা, শিল্পী কোটা, সাংবাদিক কোটা, আইনজীবী কোটা, পেশাদার কোটা ইত্যাদি কোনো কোটাই রাখা সমীচীন হবে না। বাংলাদেশ সংবিধানের বিধান অনুসারে সব নাগরিকের সমঅধিকার বিবেচনা করে সবাইকে সমান সুযোগ দিতে হবে। আবাসিক ভূমি লিজের ক্ষেত্রে একটি মাত্র যোগ্যতা থাকতে হবে অর্থাৎ বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। জমি লিজ গ্রহণে আবেদনকারী লোকের সংখ্যা প্লট সংখ্যার অপেক্ষা বেশি হলে লটারির মাধ্যমে বাছাই সম্পন্ন করতে হবে। তবে শিল্পনগরীতে শিল্প প্লট লিজ দেয়ার জন্য প্রথমে অস্থায়ীভাবে পাঁচ বছরের জন্য লিজ দিতে হবে। পাঁচ বছরের মধ্যে শিল্প স্থাপন হলে লিজ সময় আরো ৪৫ বছরের জন্য বর্ধিত করতে হবে। কোনো প্লট লিজ গ্রহীতা পাঁচ বছরের মধ্যে শিল্প স্থাপনে ব্যর্থ হলে আগ্রহী অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে লিজ দিতে হবে। কারণ অতীতে লক্ষ্য করা গেছে কিছু লোক শিল্প স্থাপনের নামে সরকার থেকে ভূমি লিজ নিয়ে বছরের পর বছর ফেলে রেখেছে।
আরো একটি বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন, বাসস্থান বা শিল্প প্লট বরাদ্দের কাজে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগ সরকারি কোনো ভূমিকা পালন করবে না। মন্ত্রণালয় কেবল অভিযোগ উত্থাপিত হলে যথাযথ অনুসন্ধান করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত বিধিবিধান অনুসারে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া এবং তা বাস্তবায়নে মনিটর করবে। যৌক্তিক মূল্যে আবাসিক প্লট এবং শিল্প প্লট লিজ দিতে হবে যাতে নাগরিকদের মৌলিক বাসস্থানের অধিকার দেয়া যায়। তাহলে স্বল্প আয়ের অনেক লোক তাদের স্বপ্নের বাড়িঘর তৈরি করতে পারবে, দেশে শিল্প স্থাপনের সুযোগ হবে, মানুষের আয় রোজগার বৃদ্ধি পাবে এবং শিল্প স্থাপনে ভূমির প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পাবে, বেকার সমস্যা অনেকাংশে লাঘব হবে।
দোহাজারীতে সড়ক বিভাগ, চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগ, দোহাজারী হাইওয়ে (পুলিশ থানা), আন্তর্জাতিক ডেকা চেন রেড স্টেশন, দোহাজারী ১৩২/ ৩৩ কেবি বিদ্যুৎ সাব স্টেশন, ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল, সিভিল সাপ্লাই/ খাদ্য গুদাম, বিএডিসি, সার, বীজ ও যান্ত্রিক প্রকৌশল স্থাপনা, দোহাজারী ভূমি অফিস, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, আখেরি রেল স্টেশন দোহাজারী, ব্যাংক, বীমা কার্যালয়, একটি ডিগ্রী কলেজ, একাধিক উচ্চ বিদ্যালয় ও মাদরাসা, লবণ ক্র্যাচিং মিল, কাঠ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প ও হস্তশিল্প, নতুন মডেলে দোহাজারী ইউনিয়ন পরিষদ ভবন রয়েছে। তা ছাড়া দোহাজারী কাঠের জন্য প্রসিদ্ধ বিধায় দোহাজারীতে একটি কাগজের কল/ পেপার মিল, বাংলাদেশের এক মাত্র সাঙ্গু নদী, যে নদী বাংলাদেশে শুরু হয়ে বাংলাদেশে শেষ, সেটা দোহাজারীতে থাকায় একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হওয়ার সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে।
কাঞ্চননগরে তাঁত বোর্ড শিল্প, ওমর সুলতান শিল্প পল্লী, রেলের সিলিপার ফ্যাক্টরী ও প্রায়ই ৩০ টি ইটভাটা বা ব্রিক ফিল্ড উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠান। তাই চন্দনাইশ উপজেলা শিল্প বান্ধব এলাকা। পটিয়া-কাঞ্চননগর- ছৈয়দাবাদ-দোহাজারী সংযোগ সড়কের দুই পাশে পাহাড়ী টিলার মধ্যে গাজীপুরের মতো শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা হলে বাংলাদেশের এটাই হবে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক জোন। কাঞ্চননগরে সিলিকা মাটি ব্যবহার করে সিরামিক ফ্যাক্টরী করা যেতে পারে।
চন্দনাইশ উপজেলা বিভিন্ন অঞ্চল মুঘল আমলেরও আগে জনবসতি গড়ে ওঠে বলে জানা যায়। একসময় পর্তুগিজ, মগসহ বিভিন্ন জলদস্যু দোহাজরীতে এসে আশ্রয় নিত। সময়ের বিবর্তনে দোহাজারী আজ খাদ্যশস্য উদ্বৃত্ত উপশহর। এখানে সাঙ্গু নদীকে কেন্দ্রে করে বাণিজ্যিক জোন গড়ে উঠতে পারে।
কাঞ্চননগর-দোহাজারীকে শিল্পাঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা কাঞ্চননগর-দোহাজারীতে শিল্পকারখানা গড়ে তোলার কথা ভাবছেন। ইতিমধ্যেই কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান এখানে শিল্পকারখানা গড়ার জন্য জমিও ক্রয় করছে। দোহাজারীকে কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানা গড়ে তোলা যায়। এখানকার মৎস্য সম্পদ কাজে লাগিয়ে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। আগামী ৫ বছরের মধ্যে এই অঞ্চল একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্পাঞ্চলে পরিণত হতে পারে। পঞ্চাশের দশক বা তারও আগে চন্দনাইশে শিক্ষিতের হার কম থাকলেও গুণগত মান ছিল খুবই উন্নত। এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে। শিক্ষিতের হার বেড়েছে।
এই চন্দনাইশ উপজেলায় কৃষি কলেজ বা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন। এখানে পরিবেশ ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে। হতে পারে একটি মেডিকেল কলেজ। তখন এখানকার শিক্ষার মানের উন্নয়ন ঘটবে। কিন্ডার গার্টেনের তুলনায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা উচ্চতর শিক্ষিত। তবে সঠিক তদারকি আর পদ্ধতিগত কারণেই কিন্ডার গার্টেনে পড়ালেখা ভালো হয়। তাই গ্রামের অভিভাবকরাও সন্তানদের এখন কিন্ডার গার্টেনে পড়াচ্ছেন। সরকার শিক্ষা খাতে এত সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে তারপরও কেন পড়ালেখা ভালো হবে না। কেন শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটবে না। তাই সবার উচিত এদিকে মনোযোগী হওয়া।
শিক্ষা বিভাগের দায়িত্বশীলদের পাশাপাশি সুশীল সমাজেরও উচিত স্কুল কলেজগুলোয় মাঝে মধ্যে তদারকি করা। প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে এলেই শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটবে বলে তার বিশ্বাস।
চন্দনাইশ উপজেলার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই উন্নত। অধিকাংশ রাস্তাই পিচঢালা। সামান্য কিছু কাঁচা রাস্তা রয়েছে। দু-এক বছরের মধ্যে তাও পাকা করা হবে।
প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের সমারোহ নিয়ে সাঙ্গু নদীর কোল ঘেঁষে জেগে ওঠা দোহাজারীকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। সমন্বিত একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে গোটা উপজেলাকেই পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা সম্ভব।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply