২০ এপ্রিল ২০২৪ / ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / রাত ১২:৪০/ শনিবার
এপ্রিল ২০, ২০২৪ ১২:৪০ পূর্বাহ্ণ

শেরতাজে অলি হযরত সৈয়দ এয়াছিন আউলিয়া (রহ.)

     

মুহাম্মদ সেলিম খান চাটগামী
আউলিয়ায়ে কেরামগণ যুগে যুগে প্রিয়নবী হযরত রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর নায়েব ও প্রতিনিধি হিসাবে মানব জাতির কল্যাণের জন্য রহমত স্বরুপ দুনিয়াতে আর্বিভুত হয়ে থাকেন। তাঁদের পবিত্র জীবন মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে আদর্শ ও নমুনা হয়ে থাকে, তাঁদের কর্মময় জীবন আল্লাহর বান্দাদের জন্য পথ পদর্শক হিসাবে গণ্য হয়। তাঁদের রহমত ও সংস্পর্শে মানব জাতির চরিত্র বদলে যায়। অত্যাচারী হয় ন্যায়পরায়ন, বাতেলপন্থী সত্যিকার নবী প্রেমিক তথা আশেকে রাসুল হয়ে যায়। বেনামাজী নামাজী হয়, দোজগী বেহেশতের উপযুক্ততা অর্জন করতে পারেন। আল্লাহ্-রাসুলের দুশমন আল্লাহর রাসুলের নৈকট্য লাভে ধন্য হয়। তাঁদের রুহানিয়াতের প্রভাবে মানব সমাজের জাহেরী ও বাতেনী অবস্থা এমনভাবে সংশোধন ও কুসংস্কারমুক্ত হয়ে যায় যে, মানুষ হক এবং সত্যের সন্ধান লাভে সফলকাম হয়। এমন কি মানুষের ভাগ্যও কিসমত পরিবর্তন হয়ে যায়। তাই জনৈক কবি সুন্দর বলেছেন “নিগাহে অলিমে ইয়ে তাছীর দে-খী” বদলতি হাজারো কী তাকদীর দেখী” আউলিয়ায়ে কেরামগণ আপন-আপন যুগের সংস্কারকের ভূমিকা পালন করে থাকেন। যাতে করে সংশ্লিষ্ট যুগের সার্বিক ও সর্বময় কুসংস্কার দুরীভূত হয়ে হক ও সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সে জন্যই কোন দেশে বা স্থানে ধর্মীয় অবনতি হয়ে মানব সমাজ গুমরাহীর অতল সাগরে ডুবে যায় তখন আল্লাহ্ পাক ইচ্ছা করে দ্বীন ও মিল্লাতের হিদায়তের জন্য আউলিয়ায়ে কেরামকে প্রেরন করেন। এসব আউলিয়েকেরামদের মধ্যে বারআউলিয়ার অন্যতম অলি অলিকুল শিরমনি হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ ইয়াছিন আউলিয়া (রহ.) অন্যতম।
প্রখ্যাত পুঁথি সংগ্রাহক মরহুম আবদুস সাত্তার চৌধুরী ও তৎপুত্র বিশিষ্ট পুঁথি গবেষক মুহাম্মদ ইসহাক চৌধুরীর গবেষণায় জানা যায়, ছৈয়দ ইয়াছিন আউলিয়া রহমতুল্লাহে আলাইহে খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর কোন এক শুভ মুহূর্তে হুলাইন গ্রামে আগমন করেন। তাঁর শুভাগমনের ঘটনার সাথে এই হুলাইন গ্রামের নামকরণ ও আবাস হওয়ার সম্পর্ক রয়েছে বলে গবেষকদের ধারণা। তাঁর পরিচয় ও আগমন সম্পর্কীয় তেমন কোন পা-ুলিপি এখনো উদ্ধার হয়নি। তবে তাঁর পরিচয় ও আগমন সম্পর্কে একটি সুপ্রচলিত কিংবদন্তী রয়েছে।
জনশ্রুতি হচ্ছে, এ গ্রামখানি কোন এক সময় প্যারাবন (আগাছা) নামে পরিচিত ছিল। এ সময় তার আশ-পাশ দিয়ে ¯্রােতস্বিনী নদী প্রবাহিত ছিল। বর্তমান হুলাইন গ্রামের দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তে ঐ সময় একদল ধুপীর বাস ছিল। এ সীমান্ত এলাকাটিকে বেলমুড়ী গ্রাম নামেও অভিহিত করা হয়। একদিন দেখা গেল কফিনসহ একটি লাশ ধোপাঘাটে আটকানো রয়েছে। স্থানীয় ধুপীরা দেখেই বুঝতে পারল, এটা কোন এক অজ্ঞাত মুসলমান সাধকের লাশ হবে। ফলে তারা কফিনটা প্যারাবনের ভেতর ঢুকিয়ে দিল। কফিনটা এসে ঠেকল অরণ্যে চলাচল পথ পার্শ্বস’ এক উঁচু ভূমিতে। ঐ অরণ্য পথ দিয়ে পথ চলতে গিয়ে জনৈক পথিক হঠাৎ আওয়াজ শুনলেন ‘আল্লাহু, হু, আল্লাহু, হু হু’ এভাবে শব্দ। তাই ঐ পথিক এ শব্দগুলো কোত্থেকে আসছে তার সন্ধানে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলেন। এভাবে কিছুক্ষণ পর দেখতে পেলেন একটি লাশের কফিন। পাশে লোকজন কেউ নেই। এ কফিন থেকে বেরিয়ে আসছে পূর্বোক্ত শব্দগুলো।
পথিক ভাবতে লাগলেন, ‘জানিনা এ কোন সাধক, নবী (দ.) প্রেমিক যাঁকে মহান আল্লাহ দয়া করে তাঁর প্রিয় বন্ধু হিসেবে কবুল করেছেন।’ ইতিমধ্যে অনেক অলি প্রেমিক লোক জমায়েত হলেন। এ সময় উপস্থিত সকল লোক অদৃশ্য এক আওয়াজ শুনতে পেলেন যে, ‘ইনি হযরত ছৈয়দ মুহাম্মদ ইয়াছিন আউলিয়া রহমতুল্লাহে আলাইহে। তাঁকে এখানে দাফন করুন।’ যথাযথ ভক্তি শ্রদ্ধাসহকারে নবী করিম (দ.) এর পবিত্র কাননের সুরভিত এ পুষ্পকে যথাযথ স্থানে দাফন করা হয়। একদিন ঘটনাচক্রে এ খবর তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর কানে পৌঁছে। ফলে রাজা এক প্রতিনিধি প্রেরণ করলেন। প্রতিনিধি তদন্ত করে বুঝতে পারলেন, কবরটি একজন মহান সাধকের। এ সাধককে ঘিরে চলছে ভক্তবৃন্দের সমবেত কণ্ঠের আল্লাহু, আল্লাহু, জিকির। প্রতিনিধি এ জিকির শুনে এ অঞ্চলের নামকরণ করলেন ‘হুলাইন’। জ্ঞানীজনদের গবেষনায় হুলাইন শব্দের বিশ্লেষন করলে দেখা যায়, ‘হু’ আরবী শব্দ। এর অর্থ তিনি। অর্থাৎ তিনিই আল্লাহ। ‘লাইন’ শব্দের অর্থ ‘কাতার’ বা সারি অর্থাৎ সমবেত কণ্ঠে ধনি উচ্চারণ বুঝানো হয়েছে, এ শব্দের মাধ্যমে। অতএব হু+লাইন=হুলাইন। অথবা ‘লাইন’ শব্দকে পৃথক করলে হয়, লা+ইন, ‘লা’ অর্থ না বা নাই এবং ‘ইন’ শব্দের আসল রূপ হলো ‘ইন্না’। এই ন্না থেকে শব্দের সংক্ষেপ বা অপরাংশ হয়ে ‘ইন’ হয়েছে। এখানে ‘ইন’ এর অর্থ হলো নিশ্চয়। সুতরাং ‘হুলাইন’ শব্দের অর্থ দাড়য় ‘নিশ্চয় তিনি আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ নেই।”
অতএব এ কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় যে, ‘হুলাইন’ গ্রামের নামকরণের সাথে সৈয়দ মুহাম্মদ ইয়াছিন আউলিয়ার আগমন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
তাঁর বেলায়তের রোশ্নী ফয়ুজাত এখানে প্রবহমান ছিল। যার প্রমাণ স্বরূপ দেখা যায়, এতদঞ্জলে তাঁর রূহানী সন্তান, নবী (দ.) প্রেমিক বেশ কয়েকজন অলির জন্মলাভ করা। তাঁরা হচ্ছেন, ষোড়শ শতাব্দীর হযরত শাহ্ মুহাম্মদ ইদ্রিছ রহমতুল্লাহে আলাইহি ও তাঁর পরবর্তী আলেম পুরুষ, সপ্তদশ শতাব্দীর হযরত হুছন ফকির ও হযরত গাজী লস্কর শাহ্ রহমতুল্লাহে আলাইহি, অষ্টদশ শতাব্দীর হযরত কবি মুহাম্মদ ফাজিল, সৈয়দ শাহ নজু ফকির, হযরত মাওলানা সৈয়দ আবদুল হামিদ, মাওলানা আছদ আলি, মাওলানা সৈয়দ আবদুল আজিজ, হযরত শাহসূফি মাওলানা এয়াকুব আলী সহেব রহমাতুল্লাহে আলাইহি (জন্ম: ১৮৮৯ ইং) প্রমুখ আল্লাহর অলিগণ। এদের মধ্যে সৈয়দ মুহাম্মদ ইয়াছিন আউলিয়া রহমতুল্লাহে আলাইহির বেলায়ত ও কামালিয়ত প্রকাশ ও প্রচারের ব্যাপারে তাঁর অন্যতম রূহানী সন্তান আওলাদে রাসূল (দ.) সৈয়দ মুহাম্মদ আবদুল হামিদ রহমতুল্লাহে আলাইহের ভূমিকা ছিল অনন্য। ইয়াছিন আউলিয়ার প্রেমের সাগরে সারাক্ষণ ডুবে থাকতেন নবী ও অলি প্রেমিক সৈয়দ আবদুল হামিদ রহমতুল্লাহে আলাইহি। যার পুরস্কারস্বরূপ তাঁর পবিত্র মাজার শরীফও প্রেমিকের পাশে থাকার একমাত্র সৌভাগ্য অর্জন করেছেন তিনি।
মাওলানা সৈয়দ আবদুল হামিদ রহমতুল্লাহে আলাইহি এক রাতে স্বপ্ন দেখলেন হযরতের কবরটি চার দেয়ালভুক্ত করার জন্য, তিনি এ কাজ করতে গিয়ে অহেতুক এক মামলার শিকার হন। হাকিম কবর গাহের বর্ণনা লিখে আনার জন্য জনৈক দারোগাকে পাঠান। দারোগা রিপোর্ট দিল যে, কবরটি উইপোকার গাড়া (উইপোকায় তোলা মাটির ডিবি) হামিদ রহমতুল্লাহে আলাইহি রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন, “যদি উইপোকার গাড়া হয়ে থাকে তো ভাল। যদি না হয় তাহলে তোর পেটেই উইপোকার গাড়া সৃষ্টি হোক।” এ কথা বলার সাথে সাথে নাকি দারোগার মুখ দিয়ে উইপোকা বের হচ্ছিল এবং এ অবস্থায় কিছু দিন পর সে মারা যায়। কারণ যারা আল্লাহর অলির সাথে বেয়াদবি করে তাদেরকে আল্লাহ পছন্দ করেন না।
এক সময় সৈয়দ মুহাম্মদ ইয়াছিন আউলিয়ার পবিত্র মাজার শরীফ ও আশ পাশের এলাকায় মাইক বাজানো যেত না। কেন তিনি মাইকের উপর নারাজ ছিলেন মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ.) ভাল জানেন। তবে পরবর্তীতে এতদঞ্চলের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন, মোজাহেদে দ্বীন মিল্লাত, আশেকে রাসূল (দ.), ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা গাজী আজিজুল হক শেরে বাংলা আল কাদেরী রহমতুললাহে আলাইহি সর্বপ্রথম এখানে মাইক ব্যবহার শুরু করেন। এ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ওয়াজ করার জন্য তিনি এখানে আগমন করেন। দীর্ঘক্ষণ একাকী মাজার জিয়ারত করেন এবং চাহেবে মাজারের সাথে রূহানী কথাবার্তা বলে মাইক ব্যবহর করার অনুমতি লাভ করেন। আজ পর্যন্ত এ নিয়ম চালু রয়েছে। আল্লামা শেরে বাংলা রহমতুল্লাহে আলাইহে ছৈয়দ মুহাম্মদ ইয়াছিন আউলিয়াকে একজন উঁচু স্তরের অলি বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, তাঁর শুভাগমন এতদঞ্চলের সুন্নীয়তের পতাকা উড্ডীন রাখার জন্য অপরিহার্য ছিল। আল্লামা শেরে বাংলা তাঁর রচিত ‘দিওয়ান-ই-আজিজ গ্রন্থে সৈয়দ ইয়াছিন আউলিয়ার শানে একটি কবিতা রচনা করেন।
উল্লেখ্য যে, এ মহান অলির নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হুলাইন হযরত ইয়াছিন আউলিয়া হামেদিয়া আবেদিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা ও এতিম খানা এবং সুবিশাল জামে মসজিদ। এটাও তাঁর আধ্যাত্মিক ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ।
কারামত বা অলৌকিক ঘটনা প্রদর্শন আউলিয়ায়ে কেরামের বেলায়তের প্রধান মাপকাঠি নয়। বরং এক্ষেত্রে সুন্নাতের রসুল (দ.) এর পরিপূর্ণ উজ্জীবিত করাই বুজুর্গীর প্রকৃত মাপকাঠি। সৈয়দ ইয়াছিন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি একজন পরিপূর্ণ আশেকে রাসূল (দ.) ছিলেন বলেই আজ ওফাত প্রপ্তির পরও তাঁর রূহানী তাওয়াজ্জুহ ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ও কারামতের বদৌলতে অগনিত পথহারা মুসলমান পেয়েছে এবং পাচ্ছেন সঠিক পথের সন্ধান। এটাই তাঁর সবচেয়ে বড় কারামত। একজন দ্বীনের পথহারা মানুষকে আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূল (দ.) এর সঠিক অনুগত ও অনুসারী করে তোলা নিছক কোন সাধকের পক্ষে সম্ভব নয়। একমাত্র একজন কামিল অলির পক্ষে এটাই সম্ভব। কোন অলির দরবারে আসার পর কোন ব্যক্তির আকিদা, আমল, আখলাক সার্বিক বিষয়ে পরিবর্তন সূচিত হওয়া ঐ অলির কামালিয়াতের উজ্জ্বল স্বাক্ষর। হযরত সৈয়দ ইয়াছিন আউলিয়া রহমতুল্লাহে আলাইহির পবিত্র দরবারের মধ্যে তা পরিপূর্ণ হারে উপস্থিত। কতো পথহারা মানুষ এ দরবারে এসে হিদায়ত প্রাপ্ত হয়েছেন তার জ্বলন্ত প্রমান এতদঞ্জরের অনেক লোক। হযরত সৈয়দ ইয়াছিন আউলিয়ার অনেক অনেক কেরামত নিত্যদিন প্রকাশিত হচ্ছে। যা’ এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে বর্ণনা করা অসম্ভব। আল্লামা রুমীর ভাষায়, “এক জমানা ছোহবতে বা আউলিয়া, বেহতর আজ ছদ ছালা তা আত বেরিয়া” অর্থাৎ প্রকৃত অলির কিছুক্ষণ সাহচর্য শত বছরের অকৃত্রিম আনুগত্যের চেয়ে উত্তম। উল্লেখ্য যে, ইসলাম প্রচারের জন্য যে বারজন অলি চট্টগ্রাম এসেছিলেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তিনি অতি উচু মাপের অলি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যযে এ মহান অলির শান মানকে বুলন্দ করার জন্য তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা লক্ষ্য করা যাচ্ছেনা। যেমন, বিশাল আকারে ওয়াজ নসিহত, খ্যাতিমান ওলামায়েকেরামের দাওয়াত করা এটা সময়ের দাবী। তবে এলাকার সর্বস্তরের সুন্নি জনতাকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কমিটি গঠন করলে এ মহান অলির শান মান তথা অত্র এলাকার সুনাম আরো বৃদ্ধি পাবে।
প্রতি বছর ১৫ ফাল্গুন এ মহান অলির পবিত্র ওরশ শরীফ অত্যন্ত শান-শওকতের সাথে শরীয়ত অনুযায়ী চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার হুলাইন গ্রামস্থ তাঁর পবিত্র দরবার শরীফ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়। হাজার হাজার ভক্ত অনুরক্ত এতে শরীক হয়ে অশেষ পূণ্য হাসিল করেন।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply