১৯ এপ্রিল ২০২৪ / ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / রাত ৮:৫৩/ শুক্রবার
এপ্রিল ১৯, ২০২৪ ৮:৫৩ অপরাহ্ণ

একদিনেই ৫০ হাজার রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ

     

সেনারা বন্দুক তাক করে রোহিঙ্গাদের পালাতে বাধ্য করছে, বন্ধ হয়নি নিপীড়ন ও আগুন দেওয়া, তীব্র খাদ্য সংকট, নৌকাডুবিতে ১১ নারী ও শিশুর লাশ উদ্ধার

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন চলছেই। মাঝখানে কিছুদিন বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ খানিকটা কম ছিল। কিন্তু গতকাল সোমবার হঠাত্ করে আবারো রোহিঙ্গা ঢল নামে। গতকাল দুপুর পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় প্রায় অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। আগতরা বলছেন, তাদের ওপর নির্যাতন ও বাড়িঘর পোড়ানো বন্ধ হয়নি। আর খাদ্য সংকট দীর্ঘস্থায়ী করতে খাবারের দোকান পোড়ানো ও ত্রাণ কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। তাদেরকে বর্মী ভাষায় ‘বাঙালি’ লেখা কার্ড জোর করে নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। সেনারা বন্দুক তাক করে রোহিঙ্গাদের দেশ ছাড়তে বলছে। নইলে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দিচ্ছে।

এরকম বাস্তবতায় পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা বোঝাই একটি নৌকাডুবি হয়েছে। কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের কাছে ইঞ্জিনচালিত নৌকাডুবির ঘটনায় ১১ নারী ও শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে গত দুই মাসে ২৬টি নৌকাডুবির ঘটনায় ১৮২ জনের লাশ উদ্ধার করা হলো।

এ প্রেক্ষাপটে বলা যায় জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের চাপে মিয়ানমারের কার্যত সরকার প্রধান অং সান সু চির পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার আশ্বাসের প্রতিফলন নেই রাখাইন রাজ্যে।

এদিকে চীনের রাষ্ট্রপরিচালিত গণমাধ্যম দ্য গ্লোবাল টাইমস এক প্রতিবেদনে বলেছে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টায় চীন ও ভারত যৌথভাবে নেতৃত্ব দিতে পারে। সমস্যাপীড়িত রাখাইন রাজ্যে মানবিক ত্রাণ সহায়তা পাঠানোর প্রস্তাবের মধ্যে দিয়ে এর সমাধান হতে পারে। মিয়ানমারে বেইজিং ও নয়াদিল্লির স্বার্থ বজায় রেখে, দেশ দুটি রাখাইনে ত্রাণ পাঠাতে, বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পুনর্বাসনে এবং মিয়ানমারের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতে সহায়তা দিতে পারে।

উখিয়া (কক্সবাজার) সংবাদদাতা জানান, গতকাল সীমান্তের নাফনদী পেরিয়ে আনজিমানপাড়া দিয়ে আসা রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন শিবিরে। সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থিদের হিংসাত্মক আচরণে বুথিডংয়ের ১৪টি গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ভোরের দিকে দলে দলে ক্ষুধার্ত, নিঃস্ব ও ভীতসন্ত্রস্ত রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ছোট ছোট সন্তানদের শরীরের সঙ্গে বেঁধে কোমরসমান পানি ও ঝোপঝাড় মাড়িয়ে এবং তীব্র প্রতিকূল স্রোত অতিক্রম করেছে তারা। এভাবে কয়েকদিন হেঁটে তারা গতকাল ভোরে বুথিডং থেকে বাংলাদেশে আসে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, মনে হচ্ছিল কখনো শেষ হবে না এমন একটি সারি বাংলাদেশের পালংখালীতে পৌঁছেছে। এদের বেশিরভাগই আহত। বয়স্কদের বয়ে আনা হয় কাঁধে করে। নারীদের মাথায় ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন: পাত্র, চালের বস্তা এবং কাপড়চোপড় দেখা গেছে।

নয়ংশপাড়া গ্রামের মাদ্রাসা শিক্ষক হাফেজ ফয়েজ উল্লাহ (৪৮) জানান, কয়েকদিন আগে বর্মী সেনা ও রাখাইন যুবকরা মাদ্রাসাটি দখল করে নেয়। তারা সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে। ওই ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের ডাকা হচ্ছে। তারপর বর্মী ভাষায় বাঙালি লেখা কার্ড নেওয়ার জন্য জোর জবরদস্তি করছে। সামরিক বাহিনীর নয়া কৌশল অনুমান করতে পেরে শিক্ষিত রোহিঙ্গারা কার্ড গ্রহণ করেনি। ক্ষিপ্ত হয়ে বর্মী সেনাবাহিনী গ্রামে গ্রামে গিয়ে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, ধান চাল লুট করছে।

মুরাপাড়া গ্রাম থেকে পালিয়ে এসে আনজিমানপাড়া বেড়িবাঁধে ৯ সদস্যের পরিবার নিয়ে বসে ছিলেন মোঃ মিয়া (৫৮)। তিনি জানান, মিয়ানমার সেনারা বাড়িঘরের মালামাল লুটপাট করছে। বিতরণ করছে সাদা কার্ড। বন্দুক তাক করে রাতারাতি দেশ ত্যাগ করার নির্দেশ দিচ্ছে। ভয়, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার কারণে বুথিডংয়ের বাপিডিপো, নাইছাদং, চিংদং, লাউয়াদং, নয়াপাড়া, চান্দেরবিল, লম্বাবিল, জংমং ও প্রংফোপাড়াসহ ১৪টি গ্রামের প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষ বাংলাদেশে এসেছে। তারা ছয় দিন পাহাড়, জঙ্গল, খাল ও ছড়া পেরিয়ে সোমবার ভোররাতে নাফনদীর এপারে চলে আসে।

অং সান সু চি সমপ্রতি মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের জবাবদিহির আওতায় আনবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন। একইসঙ্গে তিনি বলেছেন, যারা মিয়ানমারের অধিবাসী বলে প্রমাণ দেখাতে পারবে সেসব শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেবেন।

খাদ্য ও ত্রাণসহায়তা এখনো নিয়ন্ত্রিত

যেসব রোহিঙ্গা গতকাল বাংলাদেশে এসেছে তারা জানান, তারা ক্ষুধার কারণে এলাকা ছাড়ছেন। কারণ পশ্চিম রাখাইনের খাবারের দোকানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ত্রাণ সহায়তাও সেখানে নিয়ন্ত্রিত।

নৌকা ডুবিতে ২১ জনকে উদ্ধার

কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের কাছে নৌকা ডুবির ঘটনায় ২১ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। তবে এখনো নিখোঁজ রয়েছে অনেকে। গতকাল ভোররাতের দিকে অতিরিক্ত রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাটি শাহপরীর দ্বীপের কাছে বঙ্গোপসাগর উপকূলের পশ্চিমপাড়াস্থ ভাঙ্গা পয়েন্টে দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে। এসময় প্রবল ঢেউয়ের তোড়ে নৌকাটি ডুবে যায়। খবর পেয়ে স্থানীয় জেলে, জনসাধারণ ও কোস্টগার্ড রোহিঙ্গাদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে।

‘বাংলাদেশের পাশে থাকবে মালয়েশিয়া’

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের পাশের থাকার আশ্বাস দিয়েছে মালয়েশিয়া। গতকাল সকালে উখিয়ার কুতুপালং শিবির পরিদর্শনে গিয়ে এ আশ্বাস দেন মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী ড. আহমদ জাহিদ হামিদি। তিনি বলেন, আসিয়ানভুক্ত দেশ ও আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় চাপ প্রয়োগ করলে সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হবে মিয়ানমার সরকার। আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় এখন রোহিঙ্গা ইস্যুতে সোচ্চার, যেটা আগে ছিল না। এদিকে, ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের (আইওএম) মহাপরিচালক উইলিয়াম ল্যাসি সুইং বলেছেন, বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানো। গতকাল তিনি বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন।ইত্তেফাক থেকে

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply