১৮ এপ্রিল ২০২৪ / ৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / সকাল ৭:৩৬/ বৃহস্পতিবার
এপ্রিল ১৮, ২০২৪ ৭:৩৬ পূর্বাহ্ণ

অধ্যাপক সামসুজ্জামানের কাব্যে পল্লী প্রকৃতি

     

মুস্তাক মুহাম্মদ

অধ্যাপক মোঃ সামসুজ্জামান (২০.১০.১৯৫১), জন্ম যশোর সদর উপজেলার ছাতিয়ানতলা গ্রামে। লেখাপড়া বিএ (অনার্স), এমএ (বাংলা), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭৩)। ১৯৭৭ সালে যশোর কাজী নজরুল ইসলাম ডিগ্রী কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে কর্মজীবন শুরু। এখন অবসর যাপন করছেন। তিনি অধ্যাপনা করেছেন খুব সুনামের সাথে। তিনি উক্ত কলেজে বাংলা বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি শুধু বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক-ই নয়, একজন সাহিত্যিকও বটে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের উপর ভিত্তি করে অনেক কবিতা লিখেছেন। অভিনয় করতেন নাটকে। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “গর্ভ থেকে রূপ লাবণ্য”। গ্রন্থটি ততোটা সাড়া জাগাতে না পারলেও বেশ কয়েকটি কবিতা প্রশংসা কুড়িয়েছিল। সম্পাদনা করেছেন রক্ত শপথ (২০০৪), দূর্বাশা (২০০২), কর্মবীর মুন্সী মেহেরুল্লাহ স্মারক গ্রন্থ-২০০৯, ২০১০, ২০১১। সাহিত্যকে ভালবেসে তিনি এখনো একজন ২৮ বছরের তরুণের মতো তেজোদীপ্তভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আলোচনা, কবিতা আবৃত্তি করে যাচ্ছেন। তিনি বিদ্রোহী সাহিত্য পরিষদের পরপর তিনবার নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে এখনো দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এছাড়াও রাজনৈতিক ও সামাজিক অনেক প্রতিষ্ঠানে উল্লেখযোগ্য পদ অলঙ্কৃত করেছেন। গ্রামকে ভালোবেসে ভালো চাকরীর সুযোগ পেলেও তিনি যান নি। আশির দশকে তাঁর কবিতার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। তাঁর কবিতায় আছে বিদ্রোহ, উদ্দিপনা, সমসাময়িক যুগযন্ত্রণা। সমকালিন বিভিন্ন অনুষঙ্গে তাঁর কবিতা টইটুম্বর হলেও গ্রাম প্রেম তথা জন্মভূমির প্রীতি ভালোবাসা প্রকট রূপে বিস্তার লাভ করেছে। মাতৃভূমির প্রেমের গাঢ় মমতাবোধ গভীর অনুভূতি তাঁর কবিতাকে শক্তিশালী ও নতুন ব্যঞ্জনা দান করেছে।

বাংলার প্রকৃতি অপরূপ। বিশেষ করে গ্রামের রূপ লাবণ্য, সেখানকার জীবন প্রণালী সহজ সরল দক্ষিণা বাতাসে সতেজ নিঃশ্বাসে জীবন বার বার নতুন রূপ পায়। প্রকৃতি ধারণ করে বিচিত্র রূপ। সমগ্র জীবন ধরে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকলেও সে রূপের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মায় না বরং তৃষ্ণা আরো বাড়ে। জীবনের পরম বেলায় মানুষের অপূর্ণতা থেকে যায় সেই রূপ আর প্রত্যক্ষ করতে পারবে না বলে। বিতৃষ্ণ মন বিষণœতা ভর করে- যখন মনে পড়ে এই প্রকৃতি সৌন্দর্য্য ছেড়ে প্রকৃতির কোলে চিরনিদ্রায় যাবেন। তবু সত্যকে মেনে যতটুকু সময় পাওয়া যায় এই সময়ের মধ্যে বার বার বাংলা প্রকৃতির রূপ সুষমা দেখতে কবি এক মুহূর্ত নষ্ট করেন নি। মৃত্যুর আগে যত পারা যায় প্রকৃতি রূপ দেখতে চান কবি, নিচের কবিতায় তার তীব্র প্রকাশ লক্ষ্য করার মতো। তিনি লিখেছেন- “সারিবদ্ধ বৃক্ষ শাখায় মুকুলের গন্ধে/আমোদিত প্রায় চারদিক,/মাতালের সুবাসিত সুন্দর রূপ/দেখি বার বার। নিস্তব্ধ নিঝুম/একাকীত্বের সকরুণ স্বাদে নিমগ্ন হই/বিষণœতা আয়ু রেখা বরাবর দাঁড়িয়ে দেখি/প্রকৃতির সব কিছু এক দেহে লীন।” (দেখি বার বার)

মানুষের চাওয়ার সাথে পাওয়ার সংঘাত থাকে। কিন্তু কর্মবীর মানুষেরা কখনো বসে থাকে না। বন্ধুর পথ মাড়িয়ে তারা সম্মুখে তেজোদীপ্তভাবে এগিয়ে যায় কাঙ্খিত লক্ষ্যে। তারা আশা রাখে রাতের শেষে ঝলমলে আলোকউজ্জ্বল সকাল আসবে। মানুষকে অলসতা ঝেড়ে ফেলে কর্মে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। সফলতা অবশ্যই কর্মবীরদের পুরষ্কার। তাই অলসতাকে ঝেড়ে ফেলে এগিয়ে যেতে হবে কর্মের দিকে। কর্মই ধ্যান, কর্মই জ্ঞান। আলোকিত সকালের প্রত্যাশায় কবি লিখেছেন- “অলসতা ঝেড়ে কর্মের দ্রুতি নির্যাসে ভরে-/জীবন স্বপ্নের গান, গেতে গেতে যেতে হবে সম্মুখে-/একদিন হয়তো বা পৌঁছে যাব জীবন-মৃত্যু-ভালোবাসার/ টানে। সম্মুখে আঁধার। রাত শেষে আঁধার কেটে যাবে-/তারপর, পরদিনের অফুরন্ত আলো-আলোকিত করবে আমাদের।” (সম্মুখে আঁধার)

দেশ প্রেমিক নাগরিকের কাছে দেশ স্বর্গের সমান। দেশে মাটি, বায়ু, পানি প্রতিটি উপাদানই আকর্ষণীয়। নাগরিক মাত্রই দেশের কাছে ঋণী। দেশের আলো বাতাস প্রকৃতিতে তার স্বাচ্ছন্দ। গ্রাম তথা জন্মভূমির মাটি তাকে বাঁচার প্রেরণা দেয়। সতেজ নিঃশ্বাস আর নিশ্চিত জীবন দরদমাখা সম্ভাষণ যা মানুষ মাত্রই উজ্জীবিত হয়। মানুষে মানুষে, ধর্মে-কর্মে একতাবদ্ধ হয়ে সকলেই কাজ করে যে দেশে সে দেশ স্বর্গের মতো পবিত্র-শান্তিময়। পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া মাটি পরম মমতায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম লালন পালন করছে। এমন একটি শান্তিময় স্বর্গীয় গ্রাম যশোর জেলার ছাতিয়ানতলা গ্রাম। সেই গ্রামের কবির শৈশব-কৈশোর, এবং জীবনের শেষ বেলা। কবির তৃপ্ততা, কৃতজ্ঞতাবোধ এবং খাঁটি দেশ প্রেমিকের মত উচ্চারণ- “আমার গ্রামের মানুষে মানুষে, সরলতার আশ্বাসে/বিশ্বাসে বিশ্বাসে হয়ে ওঠে ¯্রষ্টার সান্নিধ্য লাভে/মহাপবিত্র স্থান আমার গ্রামের নাম ছাতিয়ানতলা যার নাম,/এই নামের মাঝে মিশে আছে কীর্তিমান পুরুষের স্মৃতি/চির অম্লান। গ্রামের মাটিতে শুয়ে আছে আমার পূর্ব পুরুষ/যাদের যোগসূত্রে গাঁথা আমি, এই গ্রামের অধম সন্তান” (অধম সন্তান)

নিজ গ্রাম তথা দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় মোঃ সামসুজ্জামানের কবিতায়। তার অনেক কবিতায় বিষয় বিষয়-বস্তু, দেশ-মাটি ও মানুষ। এই মাটিকে ভালোবেসে সবুজ-শ্যামল, ছায়া-সুনিবিড় শান্ত গ্রামের কোনো গাছতলায় কবি চিরনিদ্রায় যাবার তীব্র আশা ব্যক্ত করেছেন। যেখানে ভোরে দোয়েলের গান শুনতে পাবেন। পাবেন গ্রামের সহজ সরল মানুষের গলা ছেড়ে গাওয়া গান। যা শুনে কবি মনের পিয়াস মেটাবেন; যা পৃথিবী জীবনের অপূর্ণ রয়ে গিয়েছিলো।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply